বগুড়ায় অযত্নে পড়ে আছে নন্দীগ্রামের বধ্যভূমি

বগুড়া জেলা প্রতিনিধি, এম নজরুল ইসলাম, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৭ (বিডি ক্রাইম নিউজ ২৪) :  স্বাধীনতার ৪৬বছর পেড়িয়ে গেলেও অবহেলা অযত্নে পড়ে আছে বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলার বামন গ্রামের বধ্যভূমি। বছরের পর বছর পেড়িয়ে যাচ্ছে, তবুও বামন গ্রামের যুদ্ধকালিন সময়ের নির্মম হত্যাযজ্ঞের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে নেয়া হয়নি কোনো পদক্ষেপ। সংরক্ষণের অভাবে অরক্ষিত ও অবহেলিত অবস্থায় পড়ে আছে বধ্যভূমি। রাতের অন্ধকারে এখানে চলে মাদক সেবন, তাস ও জুয়া, এমন মন্তব্য করেছেন স্থানীয়রা। সংরক্ষণের অভাবে অরক্ষিত ও অবহেলিত বধ্যভূমি জঙ্গলে আচ্ছাদিত হয়ে পড়েছে। মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস এবং বিজয় দিবসে বামন গ্রামের বধ্যভ‚মিতে শ্রদ্ধার কোনও লেশ চোখে পড়েনা বলেও মন্তব্য করেছেন স্থানীয়রা।

সূত্রমতে, স্বাধীনতার ৪৬বছর পেড়িয়ে গেলেও দীর্ঘ এই সময়ে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে হয়েছে অনেক গবেষণা। পাতার পর পাতা ইতিহাসও রচিত হয়েছে। রচিত হয়েছে নাটক, নির্মিত হয়েছে অনেক সিনেমাও। তবে ইতিহাসের পাতায় স্থান পাওয়া দেশের অনেক বধ্যভূমি এখনও সংরক্ষণের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ফলে অবহেলায় শহীদদের স্মৃতিচিহ্ন মুছে যাওয়ার উপক্রম হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, নন্দীগ্রাম উপজেলা সদর থেকে কালিগঞ্জ সড়কের সিমলা বাজার পেড়িয়েই বামন গ্রাম। উপজেলার একটি মাত্র এই গ্রামের বধ্যভূমি সংস্কার না করায় এলাকার অসচেতন লোকজন খড়ের পালা দিয়ে ঘিরে রেখেছে চারপাশ। সেখানে বাঁধা রয়েছে গরু-ছাগল। গড়ে উঠেছে জঙ্গল। বধ্যভূমির পাশেই সাধারন মানুষের চলাচলের মেঠো পথ। একারনে সেখানকার বধ্যভুমির স্মৃতি প্রায় মুছে যাওয়ার উপক্রম। অনেকেই ভূলে গেছেন এই বধ্যভূমির কথা। সরকারিভাবে সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহন করা না হলে, মুছে যাবে বধ্যভূমির স্মৃতি, এমনি মন্তব্য করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সোবহান।

বধ্যভূমির গাছের সাথে অস্পষ্ট একটি সাইনবোর্ড ঝুলছে, ওই সাইনর্বোড এর তথ্য থেকে জানা যায়, স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে ১৯৭১সালের ৪ঠা এপ্রিল রবিবার গভীর রাতে পাক-হানাদার বাহিনীর সদস্যরা বামন গ্রামে হানা দেয় এবং জন্ম দেয় লোমহর্ষক ঘটনা। পাক-বাহিনী বাড়ি বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে বামন গ্রামের সুখ দুঃখ পুকুর পাড়ে সাড়িবদ্ধভাবে দাঁড় করে হিন্দু সম্প্রদায়ের নয় (৯) জনকে গুলি করে হত্যা করে। সেই ভয়াল রাতের নির্মম ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী কানাই চন্দ্র দুঃখ ভরা কন্ঠে বলেন, সেই ভয়াল রাত্রিতে পাকহানাদার বাহিনীরা বিভিন্ন এলাকা থেকে লোক ডেকে সুখ-দুখ পুকুরের পশ্চিম পাড়ে গর্তের ধারে জড় করে। এরপর একেএকে সবাইকে করে গুলি করতে থাকে। আমি ও আমার ভাই বলরাম এক সাথে ছিলাম। প্রথমে আমার ভাই বলরামকে গুলি করে গর্তে ফেলে দেয় পাক-সদস্যরা। তাদের গুলিতে আমার ভাইয়ের পেটের ভূড়ি বেড় হয়ে যায়। আমি ভাইকে বাঁচাতে ছুটে গেলে, আমাকে রাইফেলের বাঁট দিয়ে বেদমভাবে মারতে থাকে।

ওরা আমাকে দাঁড়াতে বলে, আমি দাঁড়াই, এরপর আমাকে তিনটি গুলি করে। ভাগ্যক্রমে গুলি ভাগেনি, তবে ধাক্কা দিয়ে আমাকে গর্তে ফেলে দেয়। আমার গায়ে চাদর জড়ানো ছিল, সেই চাদরে রক্তভরে মরামানুষের লাশের সাথে একাকার হয়ে পড়ি। সেই অবস্থায় আমার ভাইয়ের কান্নার পানি পানি শব্দ শুনতে পাই, আধামরা অবস্থায় হামাগুড়ি দিয়ে সুখ-দুখ পুকুর থেকে পানি এনে ভাইয়ের মুখে দেওয়ার কিছক্ষন পর বলরাম মারা যায়। আরেকজন প্রত্যক্ষদর্শী মির্জাপুর গ্রামের ইসমাইল হোসেন বলেন, ঘটনার দিন ভোরে কোলাহল শুনে আমি ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি অনেক লোকজনের রক্ত মাখা লাশ গর্তের মধ্যেপড়ে আছে। অনেকের ভূড়ি বের হয়ে গেছে। মর্মান্তিক ঘটনার খবর শুনে বামন গ্রামের সুখ-দুখ পুকুরপাড়ে ছুটে আসেন আশপাশ এলাকার শতশত মানুষ।

এই দৃশ্য দেখে প্রায় সকলেরই হৃদয় কেঁপে ওঠে, সকলের চোখের মায়াভরা পানি ঝড়ে পড়েছিল। যুদ্ধকালীন সময়ে তাদের কোন অপরাধ ছিলনা। তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ, এটাই ছিল তাদের একমাত্র অপরাধ। একই রাতে উপজেলার হাটকড়ই হিন্দুপাড়ায় হানা দিয়ে সুরেশ চন্দ্র, বুজেশ্বর চন্দ্র, সুরেস প্রামানিক ও অধির চন্দ্রকে হাটকড়ই হাইস্কুল মাঠে গুলি করে হত্যা করে পাক-বাহিনী। পরে তাদেরকে স্থানীয় মহাশ্মশানেই সমাধি করা হয়। সেই জায়গাটি বাশের বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *