নোয়াখালী প্রতিনিধি, লূংফুল হায়দার চৌধুরী, ১১ জুলাই, ২০২১ (বিডি ক্রাইম নিউজ ২৪) : বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণের শুরুর দিকে দেশের যে কয়টি বিশ্ববিদ্যালয় জনস্বার্থ বিবেচনায় নিজেদের সীমিত সম্পদকে কাজে লাগিয়ে দেশের মানুষের সেবাদানের জন্য করোনা পরীক্ষার ল্যাব চালু করেছিল তার মধ্যে অন্যতম নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (নোবিপ্রবি)।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. দিদারুল আলমের নেতৃত্বে এ কাজে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা এবং কর্মচারীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগে স্থাপিত করোনা টেস্টিং ল্যাবে গত বছর করোনা সংক্রমণের শুরু থেকে এ পর্যন্ত মোট ৪০ হাজারেরও অধিক নমুনা পরীক্ষার মাধ্যমে নোয়াখালী ও পার্শ্ববর্তী লক্ষ্মীপুর জেলার দশটি উপজেলার মানুষকে সেবা দিয়ে আসছে।
এই করোনা ল্যাবের ফোকাল পয়েন্টের দায়িত্ব পালন করছেন অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. ফিরোজ আহমেদ। নোয়াখালী প্রতিবেদকের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি কথা বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে করোনা ল্যাব প্রতিষ্ঠা এবং শিক্ষা ও গবেষণার নানা বিষয় নিয়ে।
প্রতিবেদক: মহামারির মত কঠিন পরিস্থিতিতেও কিভাবে যাত্রা শুরু হয়েছিল নোবিপ্রবি করোনা ল্যাবের?
ড. ফিরোজ আহমেদ: বাংলাদেশে প্রথম করোনা মহামারী শুরু হয় গত বছরের অর্থাৎ ২০২০ সালের মার্চ মাসে। সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় করোনা মহামারী ছড়িয়ে পড়া নিয়ে চরম অস্বস্তিতে পড়েছিল। সারাদেশে লকডাউন দিয়ে দেয়া হলো। ঠিক সেই সময়টাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশে জেলা সিভিল সার্জনের তত্ত্বাবধানে বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি মোকাবেলায় টেস্টিং সুবিধা চালু করার প্রস্তুতি হিসেবে নোয়াখালীস্থ আব্দুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজের পক্ষ থেকে সিভিল সার্জন এর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি ও মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের আরটিপিসিআর মেশিন ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি দেয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়। তখন আমাদের মাননীয় উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ মহোদয় এবং অধ্যাপক ড. নেওয়াজ মো. বাহাদুর আমাকে করোনা টেস্ট করার সক্ষমতা আছে কি-না তা জানতে চান। ইতোমধ্যে আমাদের বিভাগের শিক্ষার্থী মো. আমিনুল ইসলাম কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে আরটিপিসিআর টেস্টিং সহায়তা করতে চলে গেছেন। আমি আমার বিভাগের শিক্ষক, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট মো. শরিফুল ইসলাম ও আমিনুলের সাথে কথা বলে মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে করোনা পরীক্ষা সম্পন্ন করা সম্ভব বলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেই। পরবর্তীতে মাননীয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. দিদারুল আলম ও অধ্যাপক ড. নেওয়াজ মো. বাহাদুরের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয় থেকে অনুমতিপত্র বের করা হয়। নোয়াখালীতে একটি সরকারি মেডিকেল কলেজ থাকায় নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে করোনা টেস্টিং করার অনুমতি প্রদান ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট জাতীয় ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনীহা সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়। যে কারণে আমাদের ল্যাবরেটরিতে একটু দেরিতে অর্থাৎ ২০২০ সালের মাঝামাঝি থেকে করোনা পরীক্ষা শুরু হয়।
প্রতিবেদক: বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ল্যাব প্রতিষ্ঠায় কি কি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছিলেন আপনারা?
ড. ফিরোজ আহমেদ: করোনা টেস্টিং ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠায় আমাদের অনেকগুলো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছে। আগেই জানিয়েছি যে, সরকারের অনুমতি পেতে বড় ধরনের বাধা সামলাতে হয়েছে। তারপর মাত্র সাতদিনের মধ্যে সকল প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ ও মেশিনের ব্যবস্থা করা ও টেস্টিং উপযোগী নেগেটিভ ও পজিটিভ প্রেসার সুবিধাদিসহ ল্যাবরেটরি প্রস্তুত করা বিশাল চ্যালেঞ্জ ছিল। মাননীয় উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ মহোদয় ও শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. নেওয়াজ মোঃ বাহাদুরের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে এবং স্থানীয় মাননীয় সংসদ সদস্যদের আর্থিক সহায়তায় করোনা টেস্টিং চালু করা সম্ভব হয়েছে। এতকিছুর পর আমি ঢাকাস্থ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে টেস্টিং কিট ও আনুষঙ্গিক সরঞ্জামাদি আনার জন্য নিজে গিয়েছিলাম। সেখানে অতিরিক্ত মহাপরিচালক অফিসে আমাকে জানানো হল যে, মেডিকেল কলেজ ছাড়া অন্যদের টেস্টিং করার ব্যাপারে নানা ধরনের পক্ষ থেকে আপত্তি আছে। আমি তাদেরকে জনস্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব অর্থায়নে ল্যাবরেটরি প্রস্তুতকরণ, যন্ত্রাংশের ব্যবস্থা করা সহ সামগ্রিক বিষয়টি বুঝিয়ে বলার পর কেবলমাত্র টেস্টিং কিট পেয়েছিলাম। আনুষঙ্গিক অন্যান্য সামগ্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব অর্থায়নে কেনা হলো। পরবর্তীতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে করোনা টেস্টিং কিট ও আনুষাঙ্গিক সরঞ্জামাদির ব্যবস্থা করা হয়েছে। ল্যাবরেটরি পরিচালনার সকল ব্যয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে তিনবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন করোনা টেস্টিং ল্যাবরেটরির বাজেট চেয়ে পত্র প্রদান করেছে এবং আমরা যথাযথ ভাবে তা প্রেরণ করেছি। যতদূর জানি, এখনও পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের পক্ষ থেকে আর্থিক বরাদ্দ আসেনি। কথাটা এই কারণে বলছি যে, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের করোনা টেস্টিং ল্যাবরেটরি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষের জীবন ও দেশমাতৃকাকে রক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা বিনা পারিশ্রমিকে নিজের জীবনকে চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রেখে স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করার অনন্য নজির স্থাপন করেছে।
প্রতিবেদক: বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগে প্রতিষ্ঠিত এই ল্যাব পরিচালনায় বিভাগের ভূমিকা কতখানি বলে মনে করেন?
ড. ফিরোজ আহমেদ: অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগ পরিবারের শতভাগ সমর্থন ছাড়া করোনা টেস্টিং ল্যাবরেটরি প্রস্তুত করা সম্ভব হতো না। বিভাগের শিক্ষার্থীদের সেমিনার লাইব্রেরীতে করোনা টেস্টিং ল্যাবরেটরি করা হয়েছে। করোনাভাইরাসটি অতি সংক্রমণশীল হওয়ার বিভাগের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংক্রমণের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও বিভাগীয় একাডেমিক কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে ল্যাবরেটরি প্রস্তুত করার কার্যক্রমে সমর্থন দেয়াসহ সার্বক্ষণিক তদারকিতে নিয়োজিত আছে।
প্রতিবেদক: করোনাকালের স্থবিরতায় আপনাদের বিভাগের শিক্ষা কার্যক্রমের বর্তমান অবস্থা কি?
ড. ফিরোজ আহমেদ: মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম করোনা মহামারীকালেও স্বাভাবিকভাবে চলছে। প্রথমত, বিভাগের সকল ব্যাচের ক্লাস অনলাইনে নেয়া হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, বিভাগে করোনা টেস্টিং ল্যাবরেটরিসহ নিজস্ব গবেষণাগার চালু আছে। স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে তাদের গবেষণা কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে পরিচালনা করতে পারছে।
প্রতিবেদক: আপনাদের অর্জন কতটুকু? নোবিপ্রবিতে করোনাভাইরাস নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে আপনাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি?
ড. ফিরোজ আহমেদ: অনেকেই ইতিমধ্যে জেনে গেছেন যে, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা বাংলাদেশের বর্জ্য পানিতে করোনার উপস্থিতি সর্বপ্রথম আবিষ্কার করে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দল ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দল একত্রে দেশের সাতটি বিভাগের ষোলটি জেলায় এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে করোনার বিস্তৃতি, ধরণ ও বর্জ্য পানিতে করোনার পরিমান নির্ণয় করে সংশ্লিষ্ট এলাকায় করোনা আক্রান্তের সংখ্যা নির্ধারণ বিষয়ক গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সাম্প্রতি করোনাভাইরাস সংক্রমনের ফলে মানব শরীরে নানাবিধ প্রভাব নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি ও ফার্মেসি বিভাগ এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজের সমন্বয়ে একটি গবেষণা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। করোনার এই দুর্দিনে আমাদের ল্যাবে ২০০০ বোতল হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করে বিতরণ করা হয়েছে নোয়াখালীর মানুষের মাঝে। ল্যাব হতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে গবেষণাপত্রও প্রকাশ করেছি আমরা। বিভাগের শিক্ষকরা করোনা রোগীদের থেকে প্রাপ্ত নমুনা বিশ্লেষণপূর্বক রোগতত্ত্ব ও রোগ প্রতিরোধ সম্পর্কিত বেশ কিছু গবেষণা কার্যক্রম শুরু করেছে। আমাদের শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।
প্রতিবেদক: করোনা মোকাবেলায় এই মুহূর্তে সরকার ও জনসাধারণের কি কি করণীয় বলে আপনি মনে করেন?
ড. ফিরোজ আহমেদ: এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জনসাধারণকে করোনা দুর্যোগ মহামারী থেকে রক্ষা করতে সকল জনগোষ্ঠীকে ভ্যাকসিন এর আওতায় আনতে হবে। ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত জনগণকে অবশ্যই সংগনিরোধ কার্যক্রমে সহায়তা করতে হবে। ব্যক্তিগত সচেতনতা ও সাবধানতার কোন বিকল্প নাই। একইসাথে সরকার ও জনসাধারণকে দুর্যোগকালীন সময়ে সহনশীলতা ও সহমর্মিতা প্রদর্শন করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করছি।