কাশ্মিরী জঙ্গি মাজেদ ভাট ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট হামলায় ব্যবহৃত গ্রেনেড সরবরাহের মূল হোতা
ঢাকা, ২০ নভেম্বর, ২০১৭ (বিডি ক্রাইম নিউজ ২৪) : কাশ্মিরী জঙ্গি মাজেদ ভাট ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট হামলায় ব্যবহৃত গ্রেনেড জঙ্গি মাওলানা তাজউদ্দিন ও মুফতি আব্দুল হান্নানকে সরবরাহ করে। ওই হামলার লক্ষ্যই ছিলো আওয়ামী লীগ সভানেত্রী, তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করা। শেখ হাসিনাকে হত্যার লক্ষ্য সফল হলে আওয়ামী লীগ টুকরো টুকরো হয়ে যেতো এবং এদেশে নির্বিঘ্নে জঙ্গি কার্যক্রম চালানো যেতো। রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি সিনিয়র এডভোকেট সৈয়দ রেজাউর রহমান ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় আজ দ্বাদশতম দিনের মতো যুক্তিতর্ক শুনানিতে মামলার অন্যতম আসামী মাজেদ ভাট ওরফে ইউসুফ ভাটের দেয়া ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় দেয়া জবানবন্দির ভিত্তিতে যুক্তিতর্কে এ তথ্য পেশ করেন। এডভোকেট সৈয়দ রেজাউর রহমান আজ যুক্তিতর্কে আসামী মাজেদ ভাট ওরফে ইউসুফ ভাট, আব্দুল মালেক ওরফে গোলাম মোহাম্মদ ওরফে জিএম এবং মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান ওরফে অভির (জঙ্গি হান্নানের ভাই) ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি তুলে ধরেন। এ তিন আসামীই মুফতি হান্নানের দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি সমর্থন করে তাদের জবানবন্দি পেশ করেছেন।
রাষ্ট্রপক্ষ যুক্তিতর্কে জানায়, জঙ্গি মাজেদ ভাট কাশ্মিরী বিচ্ছিন্নতাবাদী হিযবুল মুজাহিদীনের সংগঠক। তিনি পাকিস্তানের পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। বাংলাদেশে মোহাম্মদপুর এলাকায় থাকতেন। তাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতো জঙ্গি তাজউদ্দিন (বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই)। তাজউদ্দিনের মাধ্যমে মাজেদ ভাট মুফতি হান্নানসহ অন্য জঙ্গিদের নিয়ে একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে। মাজেদ ভাট জঙ্গি সংগঠন হিযবুল মুজাহিদের এদেশের সংগঠক হিসেবে দায়িত্বপাপলন করছিলেন। তার অর্থ আসত পাকিস্তান থেকে। তাদের শেল্টার প্রশিক্ষন দিতো আইএসআই। পাকিস্তান থেকে চট্রগ্রাম বন্দর হয়ে গোলা-বারূদ, গ্রেনেড আসত। যা বাংলাদেশের সীমান্ত ব্যবহার করে ভারতে পাঠানোর চেষ্টা করা হতো এবং এদেশে বিভিন্ন জঙ্গি হামলায় ব্যবহার করা হতো। মাজেদ ভাট এদেশে জঙ্গি কার্যক্রমকে জোড়দার করতে পরিচয় গোপন করে সিরাজগঞ্জের মেয়ে নাহিদ লায়লা কাকনকে (এ মামলার সাক্ষি) বিবাহ করে। মাজেদ ভাটের জঙ্গি কার্যক্রমে রাজনৈতিক শেল্টারের নিশ্চায়তা দেন পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন। তাজ বলেন তার ভাই মন্ত্রী এবং সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। তাজউদ্দিন তার ভাই পিন্টুর সঙ্গেও কথা বলেছেন বলে মাজেদ ভাটকে আশ্বস্ত করেন।
আসামী আব্দুল মালেক ওরফে গোলাম মোহাম্মদ ওরফে জিএম তার জবানবন্দিতে মাজেদ ভাটের সঙ্গে তার পরিচয় এবং তার সঙ্গে বিভিন্ন সম্পৃক্তার বিষয় জবানবন্দিতে স্বীকার করেন। মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান ওরফে অভি তার জবানবন্দিতে ২১ আগষ্ট হামলার বিষয়ে মুফতি হান্নান, কাজল, সালাম, লিটন, জাহাঙ্গিরসহ অন্য জঙ্গিদের বিভিন্ন বৈঠক বিষয়ে তার জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন যা রাষ্ট্রপক্ষ আজ যুক্তিতর্কে তুলে ধরেছে। এর আগে ১৫ নভেম্বর এ মামলার আসামী মো. রফিকুল ইসলাম ওরফে সবুজ ওরফে শামীম ওরফে রাশেদ, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, মো. জাহাঙ্গীর আলম (কুষ্টিয়া), মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডা. আবু জাফর ও মাওলানা আবদুস সালামের ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় দেয়া স্বীকারোক্তী মূলক জবানবন্দির আলোকে যুক্তি পেশ করে রাষ্ট্রপক্ষ। রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক পেশ আজ অসমাপ্ত অবস্থায় মামলার কার্যক্রম আগামীকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত মূলতবি করা হয়েছে। রাজধানীর পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে স্থাপিত ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিনের আদালতে এ মামলার বিচার চলছে।
মুফতি হান্নানসহ ১২ আসামী এ মামলায় ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি পেশ করেছে। এর মধ্যে যুক্তিতর্কে হান্নানসহ ৯ আসামীর জবানবন্দির আলোকে যুক্তি পেশ করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। কাল বাকী আসামীদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি তুলে ধরা হবে। এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে মোট ৫১১ জনকে সাক্ষি করা হয়েছে। এর মধ্যে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) সিআইডির জ্যেষ্ঠ বিশেষ পুলিশ সুপার আব্দুল কাহার আকন্দসহ ২২৫ জনের সাক্ষ্য দিয়েছেন। আসামীপক্ষের ২০ জন সাফাই সাক্ষ্য দিয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ এসব সাক্ষ্য জেরা করেছে। ২১ আগষ্টের ওই নৃশংস হামলায় পৃথক দুটি মামলায় মোট আসামী ৫২ জন। মামলার আসামী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, বিএনপি নেতা সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ২৩ জন কারাগারে রয়েছে। এ মামলায় পুলিশের সাবেক আইজি আশরাফুল হুদা, শহুদুল হক ও খোদাবক্স চৌধুরী, লে.কমান্ডার (অব:) সাইফুল ইসলাম ডিউক এবং মামলার সাবেক তিন তদন্ত কর্মকর্তা- সিআইডি’র সাবেক এসপি রুহুল আমিন, সিআইডি’র সাবেক এএসপি আতিকুর রহমান ও আবদুর রশিদসহ মোট ৮ জন জামিনে রয়েছে। তারেক রহমান, বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরী, শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, মেজর জেনারেল (এলপিআর) এটিএম আমিন, লে.কর্নেল (অব:) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দারসহ ১৮ জন এখনো পলাতক। এছাড়া ৩ জন আসামী জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, মুফতি হান্নান ও শরীফ সাইদুল আলম বিপুলের অন্য মামলায় মৃত্যুদন্ড কার্যকর হওয়ায় এ মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। পলাতক আসামীদের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী রয়েছেন।
প্রধান কোঁসুলিকে যুক্তিতর্ক পেশে আরো সহায়তা করছেন আকরাম উদ্দিন শ্যামল, ফারহানা রেজা। আজ যুক্তিতর্ক উপস্থাপনকালে আদালতে উপস্থিত ছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী। এছাড়াও রাষ্ট্রপক্ষে আইনজীবী মো. আমিনুর রহমান, আবুল হাসনাত ও আশরাফ হোসেন উপস্থিত ছিলেন। অপরদিকে আসামিপক্ষে আইনজীবী আব্দুল সোবহান তরফদারসহ অন্যান্যরা আদালতে উপস্থিত ছিলেন। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় গত ২৩ অক্টোবর থেকে রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক শুরু হয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের এক সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে। ওই নৃশংস হামলায় ২৪ জন নিহত ও নেতকর্মী-আইনজীবী-সাংবাদিকসহ পাঁচ শতাধিক লোক আহত হয়। নিহতদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের পত্নী আইভি রহমান। তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের প্রথম সারির অন্যান্য নেতা এই গ্রেনেড হামলা থেকে বেঁচে যান। এতে অল্পের জন্য শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও গ্রেনেডের প্রচন্ড শব্দে তার শ্রবণশক্তিতে আঘাতপ্রাপ্ত হয়।