বগুড়ায় নববর্ষে যেখানে টাকা, সেখানেই মানুষ ফাঁকা
বগুড়া প্রতিনিধি, এম নজরুল ইসলাম, ১৫ এপ্রিল, ২০১৮ (বিডি ক্রাইম নিউজ ২৪) : বাংলা নববর্ষে উৎসবে বিনোদনকেন্দ্রে মানুষের ভিড় নেই। যে পার্কে প্রবেশ করতে লাগবে টাকা, সেখানেই ফাঁকা। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় বিনামূল্যে প্রবেশ করছেন হাজার হাজার মানুষ। যেকারণে পার্কগুলোতে দর্শনার্থীরা আসছেন না বলে মন্তব্য করেছেন বগুড়া ওয়ান্ডারল্যান্ড পার্কের ম্যানেজার সেলিম উদ্দিন।
তবে বর্ষবরণে জেলার দুপচাঁচিয়া উপজেলা সদরসহ বিভিন্নস্থানে মেলার আয়োজন করেছেন হিন্দু ধম্বালম্বীরা। সেখানে উপচেপড়া ভিড়ও দেখা গেছে। শহরসহ প্রতিটি উপজেলায় বর্ষবরণে শোভাযাত্রা, পান্তা-ইলিশের আয়োজনসহ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের করেছেন জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন।
জাগো ফুলে ফলে নব তৃণদলে/তাপস, লোচন মেলো হে। জাগো মানবের আশায় ভাষায়, নাচের চরণ ফেলো হে। জাগো ধনে ধানে, জাগো গানে গানে, জাগো সংগ্রামে, জাগো সন্ধানে, আশ্বাসহারা উদাস পরানে/জাগাও উদার নৃত্য। রবি ঠাকুর এভাবেই আবাহন করেছেন বাংলা নতুন বর্ষকে। বাঙালির জীবনে এক নতুন দিন, নতুন বারতা।
শনিবার (১৪ এপ্রিল) সূর্যোদয়ের মধ্য দিয়ে সূচনা করে বাংলা ১৪২৫ সালের। পহেলা বৈশাখ। এদিনে প্রত্যেক বাংলার ঘরে ঘরে উৎসব হয়। সব জনপদ, লোকালয়, সমতলে, পাহাড়ে বর্ণিল রঙে রাঙিয়ে তুলে বাংলা। প্রাণে প্রাণ মিলে মেতে উঠে বৈশাখী উল্লাসে।
গ্রাম থেকে শহর, নগর থেকে বন্দর সব জায়গায় প্রত্যেক বছরই দোলা দেয় বৈশাখ। মুড়ি মুড়কি, মন্ডা মিঠাইয়ের সঙ্গে নাচে-গানে, ঢাকে-ঢোলে, শোভাযাত্রায় পুরো জাতি বরণ করে নতুন বছরকে।
কিন্তু এবারের বর্ষবরণে চিত্রটাই উল্টো। পার্কে মানুষের ভিড় নেই। বগুড়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় বিনামূল্যে প্রবেশে সুযোগ থাকায় বিনোদনকেন্দ্রে প্রবেশে টাকা দিয়ে টিকিট কিনছেন না কেউ। বগুড়া ওয়ান্ডারল্যান্ড পার্কের গেটের সামনেই বাণিজ্য মেলা। যেকারনে এবাই বর্ষবরণে পার্কে প্রবেশ করতে এসে ফ্রিতেই বাণিজ্য মেলায় ছুঁটছেন মানুষ।
ওয়ান্ডারল্যান্ড পার্কের ম্যানেজার সেলিম উদ্দিন জানান, এবারের নববর্ষে পার্কে দর্শনার্থী নেই বললেই চলে। বাণিজ্য মেলায় বিনামূল্যে প্রবেশাধিকার থাকার কারণে সেখানেই ভিড় করছে মানুষ।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে জেলার আদমদীঘির সান্তাহারে শখের পললী পার্কে মানুষশূণ্য চিত্র। টিকিট কাউন্টারে ভিড় নেই। পুরো পার্কজুড়ে মাত্র শতাধিক দর্শনার্থী ছিল। অন্য দিনের তুলনায় পহেলা বৈশাখে মানুষের ভিড় দেখা যায়নি। তবে যারা পার্কে গিয়েছেন তারা প্রেমিক জুটি। অশ্লীলতা ছিল চোখে পড়ারমত। শখের পললী পার্কের মধ্যেই বর্ষবরণ অনুষ্ঠান চলছিল। সেখানে খাবারের আয়োজন থাকায় কিছু মানুষ ভিড় করেন।
অন্যদিকে বগুড়া ওয়ান্ডারল্যান্ড পার্কে গিয়ে দু-চারটি প্রেমিক জুটি দেখা গেছে। এছাড়া তিনটি পরিবার নিয়ে ঘুরতে এসেছেন কয়েকজন দর্শনার্থী। পার্কের টিকিট কাউন্টার ও মূল ফটকে মানুষের ভিড় দেখা না গেলেও পার্কের সম্মুখ গেট আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় ছিল মানুষের উপচেপড়া ভিড়।
ওয়ান্ডারল্যান্ড পার্কের সামনেই দাাঁড়িয়ে ছিলেন ম্যানেজার সেলিম উদ্দিন। অনেকটাই হতাশাগ্রস্ত ছিলেন তিনি। চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাকিয়ে ছিলেন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার দিকে। এসময় এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গতবারের চেয়ে এবার পহেলা বৈশাখে ভিড় নেই। ভিতরে গিয়ে দেখুন চারেদিকে ফাঁকা।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার ভিতরে গিয়ে কথা হয় মাহমুদ মিলন, এখলাস নাইম, জেরিন খন্দকার, শাপলা সুলতানা ও আবিদ আবিরসহ কয়েকজন দর্শনার্থীর সাথে। তারা বলেন, নববর্ষে যেখানে প্রবেশ করতে টাকা লাগে, সেখানেই মানুষ ফাঁকা। এবারের নববর্ষ শহরের রিকসায় জমে উঠেছে। রিকসায় চারপাশ ঘুরছেন আর বন্ধুদের সাথে তরুন-তরুনী ও যুবক-যুবতীরা আড্ডা দিচ্ছেন বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে। তবে গতবছরের চেয়ে এবার নববর্ষ উৎসব জমে উঠেনি।
এদিকে, বগুড়া পৌরপার্কে দিনব্যাপি দেখা গেছে অশ্লীলতার হিড়িক। এটা নতুন কিছু নয়। প্রায় প্রতিদিনই ঝাঁকে ঝাঁকে তরুন-তরুনী ও যুবক-যুবতীরা পার্কে এসে অশ্লীলতায় জড়িয়ে পড়ে। পহেলা বৈশাখে অশ্লিলতা ছিল চোখে পড়ারমত। একপাশে ঘুমাচ্ছে এক পাগল আর পাশেই প্রেমিক জুটির অশ্লীলতা চোখে পড়ে।
পৌরপার্কে ঘুরতে আসার কয়েকজন জানান, পরিবার নিয়ে এই পার্কে আসার মনই চায় না। চারেদিকে অশ্লীলতা। যেন দেখার কেউ নেই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পার্কের এক কর্মচারি বলেন, পার্কে প্রেমিক জুটি এসে অশ্লীলতায় জড়ালে কিছু বখাটে স্থানীয় ছেলেরা তাদের ছবি ধারণ করে মোটা অংকের টাকা আদায় করে থাকে। প্রয়োজনে ভিডিও প্রকাশের ভয় দেখিয়ে নিরাপদস্থানে নিয়ে যায় বখাটেরা। ধান্দার টাকা বড়বড় নেতা থেকে শুরু করে সবাই পায়। সবাই জানে, সব জায়গায় ম্যানেজ। আমি সামান্য কর্মচারি ভাই। এসব কথা আপনাকে বলে দিলাম, আমার নামটা দয়া করে লিখবেন না বা কাউকে বলবেন না।
সরেজমিনে বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের পশ্চিমপার্শে ফাঁকা মাঠেও দেখা গেছে আশ্লীলতার হিরিক। বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই চিত্র প্রতিদিনই চোখে পড়ে। অথচ সেদিকে দেখার কেউ নেই।
বিনোদন কেন্দ্রসহ বিভিন্ন জায়গায় প্রেমিক জুটিকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখা যায়। এই অবস্থায় ছাত্র-ছাত্রীদের নৈতিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এসব কারণে শিক্ষক ও অবিভারকরাও তাদের সন্তাদের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।
অন্যদিকে, শহরসহ জেলার ১২টি উপজেলা সদরের মার্কেটগুলোতে বিকিকিনিতেও ভিড় দেখা যায়নি। বৈশাখের একমাস আগেই অহরহ নতুন নতুন বৈশাখী পোষাক কিনে মার্কেট সাজিয়ে তুলেন ব্যবসায়ীরা। এবারের উৎসবে ক্রেতা নেই।
বেচাবিক্রি না থাকায় প্রতিটি মার্কেট বৈশাখী পোষাকের স্তুপে পরিণত। ক্রেতা সংকটে এবার অধিক লোকসানে পড়তে হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ব্যবসায়ীরা।