শুধু নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার করে সমস্যার সমাধান হবে না : মোশাররফ হোসেন মুসা
সম্পাদকীয় (কলাম) ০১ জুলাই, ২০২২ (বিডি ক্রাইম নিউজ ২৪) : স্থানীয় শাসন বিষয়ক গবেষক ড. তোফায়েল আহমেদ গত ২১ জুন’২২ তারিখে দৈনিক সমকালে’ নির্বাচন নিয়ে সংস্কার ও চর্চার সুপারিশ’ শিরোনামে একটি গুরুত্বপূর্ণ কলাম লিখেছেন। সকলে একমত হবেন যে, সময়োপযোগী শাসন ও নির্বাচনী ব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়ে বর্তমানে যথেষ্ট পরিমান গবেষণা নেই। সেক্ষেত্রে ড. তোফায়েল আহমেদের কলামটি অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে।
তাঁর সুপারিশের কয়েকটি পয়েন্ট সংক্ষিপ্ত করলে যা দাড়ায় তা হলো ১. ‘ফাস্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ ব্যবস্থার বদলে সমানুপাতিক ব্যবস্থা; ২. দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদীয় ব্যবস্থা; ৩. ভোটার বা জনগণকে নির্বাচনের প্রতি আস্থাশীল হওয়ার জন্য আইনের শাসনের ব্যবস্থা করা; ৪. মধ্যবিত্তদের নির্বাচনের প্রতি নিরাসক্ত মনোভাব দূর করা; ৫. প্রবাসী কিংবা এলাকার বাইরে অবস্থানকারী ভোটারদের জন্য ‘পোস্টাল ভোট’-এর ব্যবস্থা করা ও ৬. একক তফসিলে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের ব্যবস্থা করা।
উপরিউক্ত সুপারিশের সমান্তরালে আরও কিছু প্রস্তাবনা বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। আস্থার সমাজ গড়ার স্বার্থে স্থানীয় গন্যমান্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ‘স্থানীয় নির্বাচন কমিশন’ এবং জাতীয় পর্যায়ের গ্রহণযোগ্য দলীয়-নির্দলীয় ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ‘জাতীয় নির্বাচন কমিশন’ গঠন করা উচিত। স্থানীয় নির্বাচন কমিশন একক ক্ষমতাবলে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন সম্পন্ন করবে এবং জাতীয় নির্বাচন কমিশনও একক ক্ষমতাবলে জাতীয় প্রতিনিধিদের নির্বাচন সম্পন্ন করবে।
এদেশে দীর্ঘদিন থেকে বণিক সমিতি, প্রেসক্লাব, ছাত্র সংগঠন, শিক্ষক সংগঠন নিজেরাই নির্বাচন কমিশন গঠন করে নির্বাচন সম্পন্ন করছে। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে, তারা যদি সক্ষম হয় তাহলে একই জনগণ স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচন করতে কেন সক্ষম হবে না! সমানুপাতিক ভোটের ব্যবস্থা চালু হলে জাতীয় পর্যায়ে ঐক্যমত সৃষ্টি হবে সন্দেহ নেই; কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে মেয়র কিংবা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনে জটিলতা দেখা দিবে। সেজন্য তিনি স্থানীয় সরকারেও সংসদীয় ব্যবস্থা চেয়েছেন।
আমরা দেখে আসছি জাতীয় পর্যায়ে দলীয় বিভাজন থাকলেও স্থানীয় পর্যায়ে জনগণ মিলেমিশে বসবাস করে। কিন্তু স্থানীয় সরকারে দলীয় প্রতীক দেয়ায় পুর্বেকার সেই মিলমিশের সম্পর্ক আর থাকছে না। একই সঙ্গে মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে আগত নির্দলীয় ব্যক্তিদের নির্বাচন করার পথটি সংকুচিত করে দেয়া হয়েছে। আবার যদি সেখানে সংসদীয় ব্যবস্থা চালু হয়, তাহলে প্রায়ই মেয়র ও চেয়ারম্যান পরিবর্তনের ঘটনা ঘটতে দেখা যাবে৷ তবে এটা ঠিক, ক্ষমতার ভারসাম্য না থাকায় মেয়র ও চেয়ারম্যানরা কাউন্সিলর/ মেম্বরদের মতামতের দাম দেন না।
এদেশে প্রদেশ না থাকায় পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের প্রতিনিধিরা কোথা থেকে আসবে তা ভেবে দেখা দরকার। সেজন্য ‘জেলা সরকার’ ব্যবস্থা কার্যকর করে প্রতিটি জেলা সরকার থেকে দু’জন প্রতিনিধি (মোট ১২৮ জন) নিয়ে উচ্চকক্ষ করা যেতে পারে। তবে সর্বাগ্রে দুই প্রকারের সরকার ব্যবস্থা, তথা জাতীয় সরকার ব্যবস্থা ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা কার্যকর করতে হবে।
লক্ষনীয় যে-সরকার, বিরোধী দল, বুদ্ধিজীবী সমাজ, এনজিও সহ সকলেই ‘স্থানীয় সরকার’ শব্দটি ব্যবহার করছেন (যদিও সংবিধানে ‘স্থানীয় শাসন’ শব্দটি যুক্ত রয়েছে)। সেকারণে প্রতিটি স্থানীয় ইউনিটের সঙ্গে ‘সরকার’ শব্দটি যুক্ত করে প্রজাতান্ত্রিক রূপ দিলে সকল দলের সমর্থন পাওয়া যাবে। যেমন- ইউনিয়ন সরকার, উপজেলা সরকার, জেলা সরকার, নগর সরকার ইত্যাদি।
সেই সঙ্গে দ্রুত নগরায়নের বিষয়টি মাথায় রেখে স্থানীয় ইউনিটগুলো সাজাতে হবে। প্রস্তাবিত ইউনিয়ন সরকার, উপজেলা সরকার, নগর সরকার ও জেলা সরকারের রূপরেখা সংসদীয় পদ্ধতি হবে, না রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি হবে, তা আলোচনা সাপেক্ষ। এ ব্যবস্থায় ‘জেলা সরকার’ স্থানীয় সরকারের সর্বোচ্চ ইউনিট হিসেবে কার্যকর থাকবে। জেলা সরকার এক হাতে গ্রামীণ স্থানীয় সরকারগুলো এবং অন্য হাতে নগর সরকারগুলো নিয়ন্ত্রণ করবে। কেন্দ্রের সঙ্গে শুধু জেলা সরকারের সম্পর্ক থাকবে।
এখানে সংক্ষেপে নগর সরকারের রূপরেখা তুলে ধরা যেতে পারে। নগর কাউন্সিল বিভাগ, নগর বিচার বিভাগ ও নগর প্রশাসনিক বিভাগ মিলে ‘নগর সরকার’ গঠিত হবে (মজার বিষয়, নগরে কাউন্সিলর আছে; অথচ কাউন্সিল নেই)। নগর সরকারকে ওয়াচ করার জন্য একজন অভিভাবক, তথা শেরিফ অথবা ন্যায়পালের পদ সৃষ্টি করা যেতে পারে। তাছাড়া নগর সরকারের বাইরে নগর নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে।
একই নিয়মে ‘জেলা সরকার’, ইউনিয়ন সরকার’, ‘উপজেলা সরকার’ (যদি এ ইউনিটটির প্রয়োজনীয়তা থাকে) গঠন করতে হবে। তবেই সকল নাগরিকের মাঝে ‘আমিই সরকার, আমিই জনগণ’ চেতনাটি সর্বক্ষণ জাগরূক থাকবে- তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
লেখক: গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার ও গণতন্ত্রায়ন বিষয়ক গবেষক। email- musha.pcdc@gmail.com,