গাইবান্ধা প্রতিনিধি, মোঃ একরামুল হক, ২১ জুন, ২০২০ (বিডি ক্রাইম নিউজ ২৪) : দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রান মন্ত্রণালয়ের অধীনে টিআর/কাবিটা কর্মসুচির আওতায় দুর্যোগ সহনীয় বাসগৃহ নির্মান প্রকল্পে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের গাইবান্ধা জেলার ৭ উপজেলায় ৪শ ২০টি ঘর নির্মানের কাজ চলছে । সরকারের লক্ষ অনুযায়ী বিনা মূল্যে এই ঘর গুলো হতদরিদ্রদের মাঝে বিতরণের কথা থাকলেও গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার মুক্তিনগর ইউপি চেয়ারম্যান আরশাদ আজিজ রোকন, মেম্বার আব্দুল ওয়াহেদ সাজু ও শামসুজ্জোহা, কচুয়া ইউপি চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান, ঘুড়িদহ ইউপি চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ, মহিলা মেম্বার আঙ্গুর বেগমের বিরুদ্ধে ৭০ হাজার থেকে লক্ষাধিক টাকা ঘুষ গ্রহনের অভিযোগ উঠেছে । অভিযুক্ত চেয়ারম্যানরা দুর্যোগ সহনীয় বাসগৃহ নির্মান প্রকল্প সভাপতি আর ইউপি মেম্বাররা প্রকল্প সদস্য। বিনামুল্যের ঘর দিতে লাখ টাকার ঘুষ বাণিজ্যের কারনে সরকারের ভাবমুর্তি খুন্ন করা হচ্ছে মনে করছেন সচেতন মহল। বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের কথা জানান গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক ।
সরেজমিনে গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ঘুড়ে দেখা যায়, বাংলাদেশ সরকারের দুর্যোগসহনীয় বাসগৃহ নির্মাণ কাজ চলছে। কোন কোন ঘরে ইটের ওপর ইট গেথে গাথুনি চলছে, কোন কোন ঘরে আবার রংয়ের কাজ চলছে। কোনটি রং করার অপেক্ষা। কোন ঘর নির্মান শেষ। সরকারের এই ঘর পেয়ে হয় তো খুশিতে উপকার ভোগীরা সরকারকে ধন্যবাদ জানোর কথা। কিন্তু সরকারকে ধন্যবাদ তো দুরের কথা উল্টা অভিযোগের শেষ নেই । ৩ লাখ টাকার ঘর নিতে নাকি দিতে হয় লাখ টাকা ঘুষ!
২০১৯-২০২০ অর্থবছরের সরকারি ঘর পাওয়া সাঘাটা উপজেলার মুক্তিনগর ইউনিয়নের ধনারুহা গ্রামের স্বপ্না বেগম জানান, “নির্মান শ্রমিক হিসাবে তার স্বামী বিভিন্ন গ্রামে কাজ করেন। তার এক মেয়ে ঢাকায় গার্মেন্টস শ্রমিক। অভাবের সংসারে পাকা ঘরে থাকার ইচ্ছা থাকলেও নেই উপায়। এমন সময় মুক্তিনগর ইউপি সদস্য ও প্রতিবেশী আব্দুল ওয়াহেদ সাজু দেখালেন পাকা ঘরের স্বপ্ন ।কম খরচেই মিলবে ঘর। দুটি পাকা রুম একটি রান্নাঘর বাথরুমসহ সরকারের ডিজাইনের চেয়ের বেশী কিছু আছে বলে স্বপ্ন দেখানোর পরে দের লাখ টাকা ঘুষ চায় । তাই ধার দেনা করে ও নিজের জমানো টাকা, গার্মেন্টস কর্মী মেয়ের জমানো টাকা একত্রে করে মেম্বারের হাতে এক লাখ ১৫ হাজার টাকা তুলে দেয় । বছর যেতে না যেতেই পেয়ে যায় সরকরি ঘর।”
এই ইউনিয়নের শ্যামপুর গ্রামের একটি মসজিদের মুয়াজ্জিন আব্দুল হান্নান ব্যাপারীর স্ত্রী সোহাগিনী বেগম জানান, “আমরা ঘর নিয়ে কি যে ভুল করেছি নিজেও জানি না। একটি ঘর নিতে ইউপি চেয়ারম্যান আরশাদ আজিজ রোকনকে ৭০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে ।”
২০১৯-২০২০ অর্থবছরের তালিকায় ধানঘড়া গ্রামের শুকুর উদ্দিনের নাম থাকলেও সরেজমিনে ঘরের মালিক দুদু মিয়া। দুদু মিয়ার স্ত্রী মঞ্জিলা বেগম জানান, “গরু বিক্রি করে নগদ ৮০ হাজার টাকা দেই মুক্তিনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আরশাদ আজিজ রোকনের হাতে। সরকার নাকি বিনামুল্যে ঘর দেয় আমরা পেলাম কই।”
মুক্তিনগর ইউনিয়নের ভরত খালি গ্রামে মৃত বাদশা মিয়ার ছেলে কফিল উদ্দিনের নাম থাকলেও আসলে ঘরের মালিক কফিল উদ্দিনের ছোট ভাই রফিকুল ইসলাম। ঘর নিতে কত টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে জানতে চাইলে রফিকুল ইসলাম ও তার কহিনুর বেগম জানান, “এক লাখ ৮ হাজার টাকা মুক্তিনগর ইউনিয়নের মেম্বার শামসুজ্জোহার হাতে দিয়ে ঘর পেয়েছি ।”
অপরদিকে সাঘাটার কচুয়া ইউনিয়নের নতুন ঘরের তালিকা শুরু হতে না হতেই টাকা নেয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে কচুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও প্রকল্প কমিটির সভাপতি মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে।
কচুয়া ইউনিয়নের উল্যাসোনাতলা গ্রামের ভ্যানচালক শাহজাহান আলী জানান, “আমি একটি ঘরের জন্য কচুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমানের কাছে ৯০ হাজার টাকা দিয়েছি। ঘরের কাজ শুরু হলে বাকি টাকা দিতে হবে। ”ভ্যানচালক শাহ জাহান আলীর স্ত্রী মেলেনা বেগম জানান, “আমার প্রতিবন্ধি মেয়ের জন্য একটি ঘর চেয়েছি। একটি ঘরের জন্য মোট ১ লাখ ২০ হাজার টাকা চেয়ারম্যানকে দিতে হবে। এর মধ্যে ধার দেনা করে কিস্তি নিয়ে নগদ ৯০ হাজার টাকা দিয়েছি। তা নাহলে সরকারি ঘর দেয় না। কি করবো বাবা কিছু তো করার নেই।”
কচুয়া ইউনিয়নের উল্যাসোনাতলা গ্রামের ভ্যানচালক চাঁন মিয়া জানান,”মনে বড় আশা ছিল ইটের তৈরি পাকা ঘরে থাকবো। সরকারি পাকা ঘরের খোজ নিতে কচুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করলে চেয়ারম্যান এক লাখ টাকার দাবী করেন। পরে নগদ এক লাখা টাকার বিনিময়ে ঘর পেয়েছি ।
সাঘাটা উপজেলার ঘুড়িদহ ইউপির একই চিত্র। চলতি অর্থবছরের সরকারি ঘর পাওয়া উপকার ভোগী ঘুড়িদহ ইউনিয়নের ছমিতন বেগম জানান, “সরকারি একটি ঘরের জন্য ঘুড়িদহ ইউপি মহিলা মেম্বার আঙ্গুর বেগম ও তার স্বামী মোফাজ্জল হোসেনের হাতে ৮০ হাজার টাকা দিয়েছি।”
ঘুড়িদহ ইউনিয়নের ঝাড়াবর্ষা গ্রামের মোছামাৎ বেগমের ছেলে জাহিদুল ইসলাম জানান, “একটি ঘরের জন্য ইউপি মেম্বারের সহযোগী মোহাম্মদ ভনডুলের হাতে ৮০ হাজার টাকা দিয়েছি। ঘরের নির্মাণ কাজ শেষ এখন টিনের চালা লাগানো বাকি। কাজ শেষে আরো দিতে হবে।”
এ ইউনিয়নের ঝাড়াবর্ষা গ্রামের খোতেজা বেগমের ছেলের বৌ দুলালী বেগম জানান, “একটি ঘরের জন্য ঘুড়িদহ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল কামাল আজাদের কাছে ৭০ হাজার টাকা দিয়েছি । ঘরের নির্মাণ কাজ শেষ এখন বারান্দার কাজ বাকী আছে।”
শান্ত মিয়া নামের নির্মাণ শ্রমিক জানান, “সরকারী ডিজাইন অনুযায়ী আমরা যখন গৃহনির্মান কাজ করি তখন উপকার ভোগীরা বাধা দেয়।সরকারের বিনামুল্যের ঘরের জন্য ঘুষের টাকা লেনদেনের কারনে প্রতিদিন লাঞ্চিত হতে হয় নির্মান শ্রমিকদের। ডিজাইন অনুযায়ী কাজ করতে বাধার সুম্মুখিন হয়ে বিঘ্ন হতে নির্মান কার্যক্রম।”
বিনামুল্যের ঘর বিতরণে ঘুষ গ্রহন অভিযোগ বিষয়ে জানতে গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার মুক্তিনগর ইউপি চেয়ারম্যান আরশাদ আজিজ রোকন, মেম্বার আব্দুল ওয়াহেদ সাজু ও শামসুজ্জোহা, কচুয়া ইউপি চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান, ঘুড়িদহ ইউপি চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ, মহিলা মেম্বার আঙ্গুর বেগমের সাথে মোবাইল ফোনে কথা হলে সবাই অস্বীকার করেন ।
এই বিষয়ে সচেতন মহলের মতামত নিতে গাইবান্ধার সমাজ সেবক ও সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম বাবু’র সাথে কথা হলে তিনি জানান, “সরকারের বিনা মুল্যের ঘরে যদি কোন জনপ্রতিনিধি ঘুষ বাণিজ্য করে থাকে তাহলে সরকারের ভাবমুর্তি খুন্ন হবে । তাই যথাযথ কর্তপক্ষকে এই বিষয়টি তদন্তপূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করে অভিযুক্ত জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দরকার ।