রাজারহাটে চাকিরপশার নদী প্রভাবশালীদের দখলে
রাজারহাট (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি, ইব্রাহিম আলম সবুজ, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২০ (বিডি ক্রাইম নিউজ ২৪) : রাজারহাট উপজেলার একটি নদী চাকিরপশার, ষাটোর্ধ্ব নূর মোহাম্মদ মুক্তিযুদ্ধের আগে সংসার টানতে শুরু করেন শুধু এই নদীতে মাছ ধরেই। প্রচুর মাছ উঠত জালে। নিজেই সেই মাছ বাজারে বিক্রি করতেন। বর্ষায় পানি এলে চাকিরপশার ফুলেফেঁপে উঠত। তাতে ঝাঁকে ঝাঁকে ভেসে আসত নতুন মাছ। নদীর জলরাশিতে গোসল করত মানুষ, নদীপাড়েই দিনের বেশিরভাগ সময় কাটত তাদের। অনন্ত যৌবনা নদীর স্রোতে গা ভাসিয়ে দিত অসংখ্য নৌকা। মাছের উদ্দাম ছুটোছুটিতে হেসে উঠত নূর মোহাম্মদের মন। অথচ তাকে এখন জীবনযাপন করতে হয় রিকশা চালিয়ে।
স্থানীয়রা জানান, চাকির পশারের প্রস্থ কোথাও কোথাও ছিল প্রায় এক কিলোমিটার। ২৫-৩০ বছর আগেও এ নদীর পানি গিয়ে ব্রহ্মপুত্রে পড়ত। এখন এ নদী উলিপুর উপজেলার থেতরাইয়ে তিস্তা নদীতে গিয়ে মেশে। এ নদী মূলত বুড়িতিস্তা নদীর উজানের অংশ। নদীটির উৎপত্তিস্থল রাজারহাট উপজেলার সদর ইউনিয়নের ইটাকুড়ি নামের নিম্নাঞ্চল দোলা থেকে রাজারহাটের আবুল কালামের জীবনযাপনই ছিল জলাভূমি কেন্দ্রিক। কিন্তু আশির দশকে চাকিরপশার নদীর ওপর অত্যাচার বাড়তে থাকে। নদীর বুকে একটি রাস্তা নির্মাণের ফলে স্থবির হয়ে যায় এর প্রবাহ।
এরপর নদীতে বাঁধ দিয়ে পুকুর তৈরির প্রতিযোগিতা চলে। দখলের তালিকায় রয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতা ও প্রভাবশালী ব্যক্তি। পুকুর তৈরির অভিযোগ রয়েছে ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও। আবুল কালাম দুঃখ করে বলেন, সড়ক নির্মাণের পর নদীকে টুকরো টুকরো করে পুকুর করা হয়েছে। খরস্রোতা ও গভীর নদীর পথজুড়ে এখন দখলের প্রতিযোগিতা। নদীতে নামতেও মানা তীরবর্তী মানুষজনের। এ নির্দেশ উপেক্ষা করলেই নেমে আসে অত্যাচারের আখড়া। অথচ পেটের জ্বালা মেটাতে মাছ ধরার বিকল্পও খুঁজে পাচ্ছেন না স্থানীয়রা।
এলাকাবাসী এখনও ভাবতেই পারেন না, নদীকে এভাবে টুকরো টুকরো করা যায়। এদিকে নদী কিংবা পরবর্তী প্রজন্মের জীবিকা নিয়ে ভাবার সময় নেই নীতি নির্ধারকদের। এমনকি মৎস্যজীবীরাও উপেক্ষিত তাদের কাছে। চাকিরপশার অনেকটা অংশই বর্তমানে অর্ধশতাধিক পুকুরের সমষ্টি। একেকটি পুকুর পাঁচ থেকে ২৫ একর আয়তনের।
এখানেই শেষ নয়। ১৯৯৬ সাল থেকে এ নদীর ১৪১ দশমিক ২৯ একর জমি জলমহাল হিসেবে ইজারা দেওয়া হচ্ছে। এরপর নদীর পাশাপাশি নদীপাড়ের মানুষের ওপরও বেড়েছে নির্যাতন। জলমহাল নীতিমালার ২১ নম্বর ধারার ৯-এর ক অনুচ্ছেদে বলা আছে- প্রকৃত মৎস্যজীবী ভিন্ন অন্য কাউকে জলমহাল বন্দোবস্ত দেওয়া হবে না। অথচ এখন যাদের বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে, তাদের একজনও মৎস্যজীবী নন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নদীর পাড়ের এক বাসিন্দা বলেন, দখলদারদের সঙ্গে প্রশাসনের লোক নদীতে ঘুরি বেড়ায়। সরকারি টাকায় কেনা মাছের পোনা দখল করা নদীতে ছাড়ি দেইল। এ নদীতে হামার মতো জালুয়াক মৎস্যজীবী তো নাইমবার দেয় না।
এদিকে প্রশাসন থেকে নদীর বুকে পুকুর গড়ে মাছ চাষে উৎসাহিত করা হচ্ছে মানুষজনকে। যদিও মাছ চাষের সমবায়গুলোও যাত্রা শুরু করেছে দলীয় রাজনীতির আখড়া হিসেবে। যারা বংশপরম্পরায় মাছ ধরেন, তাদের মৎস্যজীবী পরিচয়পত্র থাকলেও মাছ ধরার অধিকার নেই। আবুল কালামের আইডি কার্ড মৎস্যজীবীর হলেও নদীর মাছ ধরার কোনো অধিকার নেই। তিনি দুঃখ করে বলেন, বাড়ির উঠানোত নদী। প্রতিদিন ঘুম থে উঠি ঘর থে বাইর হয়া নদীর মুখ দেখি। কিন্তু ভয়ে নদীত নাইমবার পাই না। হামরা কী খায় বাঁচি থাকি।
নদী বিষয়ক নাগরিক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক এবং চাকিরপশার নদী সুরক্ষা কমিটির সমন্বয়ক ড: তুহিন ওয়াদুদ বলেন, যতরকম অত্যাচার চলতে পারে, তার সবই হয়েছে চাকিরপশারের ওপর। নদী তীরবর্তী মানুষজনের ওপর অত্যাচারের কাহিনিও কম লোমহর্ষক নয়। নদীর ওপরের পুকুরগুলো ব্যক্তিমালিকানায় থাকার কারণে তার পানি পর্যন্ত ছুঁয়ে দেখাও সম্ভব নয় সাধারণ মানুষের পক্ষে।
কয়েকজন জানিয়েছেন, নদীর তীর ধরে রাতে হাঁটতে গেলেও মুহূর্তেই জ্বলে ওঠে অসংখ্য টর্চলাইট। তারপর চলে নানা রকম জিজ্ঞাসাবাদ, চলে নির্যাতন।
২০-২৫ হাজার একর কৃষিজমির ক্ষতি চাকিরপশার নদীর ওপর সেতু না করে আড়াআড়ি সড়ক নির্মাণের কারণে জলাবদ্ধতা চরমে উঠেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, নদীর পানি বের হতে না পারায় উজানের ছাটমল্লিকবেগ, দিনা, নাটুয়ামহল, পুটিকাটা, পুনকর, চেতনা, দেবীচরণ, দক্ষিণ প্রাণপতিসহ বেশ কয়েকটি মৌজার প্রায় ২০-২৫ হাজার একর জমিতে এখন চাষাবাদ বন্ধ হয়ে গেছে।
চাকিরপশার নদী সুরক্ষা কমিটির আহ্বায়ক খন্দকার আরিফ বলেন, উজান ও ভাটিতে নানা প্রতিবন্ধকতার মাধ্যমে পানিপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করায় দুই ফসলি জমি ফসলহীন হয়ে পড়েছে, ক্ষতি হয়েছে কৃষকদের। গজেন্দ্রনাথ রায় নামে এক কৃষক বলেন, তার পাঁচ একর জমিতে এ বছর কিছুই চাষ করতে পারেননি। এখানকার অবস্থা খুবই করুণ।
নদী মুক্তির আন্দোলন, আজ সমাবেশ গত দুই বছর ধরে নদীটিকে দখলমুক্ত করতে চাকিরপশার নদী সুরক্ষা কমিটি মানববন্ধন, নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান বরাবর স্মারকলিপি পেশ, পথসভা, লিফলেট বিতরণসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে। এমন প্রেক্ষাপটে গত ৬ আগস্ট নদী থেকে দখল উচ্ছেদ, নদীর ওপর আড়াআড়িভাবে নির্মিত রাস্তার উপযুক্ত স্থানে সেতু স্থাপন এবং অবৈধ বন্দোবস্ত বাতিলের জন্য কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসকের কাছে চিঠি দেয় জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। এ নিয়ে সর্বমোট ছয়টি চিঠি পাঠানো হয়েছে জেলা প্রশাসনের কাছে। কয়েকবার চিঠি চালাচালির পর জেলা প্রশাসক ২২ জন দখলদারের একটি তালিকা তৈরি করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের কাছে পাঠান।
গত ৫ মার্চ নদীটি লিজ না দেওয়ার নির্দেশনা দিয়ে চিঠি দেয় জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। কিন্তু নির্দেশনা আমলে না নিয়ে অমৎস্যজীবীদের কাছে নদীটির প্রায় ১৫০ একর বন্দোবস্ত দেয় জেলা প্রশাসন। এবছর ২৩ আগস্ট আবারও লিজ বাতিলের জন্য চিঠি দেয় কমিশন। কিন্তু এখনও অমৎস্যজীবীদের দেওয়া বন্দোবস্ত বাতিল হয়নি। বরং নির্দেশনা উপেক্ষা করে রাজারহাট উপজেলা প্রশাসন অর্ধশত কেজি মাছের পোনা অবৈধ লিজগ্রহীতাদের জন্য ছেড়ে দেয়। নদী মুক্ত করার লড়াইয়ে যারা আছেন, তাদের বিভিন্নভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এ নিয়ে চাকিরপশার নদী সুরক্ষা কমিটির আহ্বায়ক খন্দকার আরিফ থানায় সাধারণ ডায়েরিও করেছেন। তবে নদী রক্ষায় আজ শনিবার রাজারহাটে সমাবেশ ডেকেছে চাকরিপশার নদী সুরক্ষা কমিটি।
দখলদার কারা গত ৫ মার্চ করা জেলা প্রশাসনের তালিকায় নদী দখলদারদের মধ্যে রয়েছেন- বিএনপি নেতা ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান হাবিবুল্লাহর ছেলে আহসান হাবীব, সদর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান জাতীয় পার্টির নেতা পনির উদ্দিনের ছেলে বাবলু মিয়া, বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান জাহিদ ইকবাল সোহরাওয়ার্দ্দী বাপ্পী, উপজেলা কৃষক লীগের সাবেক সভাপতি ইউনুছ আলী, উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আবু সায়িদ চৌধুরীর ছেলে নাহিদ আলী, বিএনপির সমর্থক ও রাজারহাট সদর ইউনিয়নে গতবার বিএনপির চেয়ারম্যান প্রার্থী ফারুক মন্ডল ও ঠিকাদার নজরুল ইসলাম। এ ছাড়া স্থানীয় দখলদার হিসেবে তালিকায় রয়েছেন আবদুস ছালাম, মোজাম্মেল হক, রাজু মিয়া, আবদুস ছালাম (২), আজগার আলী, বাচ্চা হাজী, রফিকুল ইসলাম, হামিদুল ইসলাম, সোহেল রানা, আফতার হোসেন, হাসেন আলী, আহম্মদ আলী, আনিছুর রহমান, দুলাল মিয়া ও জুয়েল চৌধুরী। তবে নদীর দখলদারের সংখ্যা একশর চেয়ে বেশি হবে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
যেভাবে সূত্রপাত নদীপাড়ের বাসিন্দারা জানান, এরশাদ সরকারের আমলে সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত এ কে এম মাঈদুল ইসলামের আত্মীয় মীর ইসমাইল হোসেনের বাড়ি যাওয়ার জন্য পাঠানহাটে নদীর ওপর একটি আড়াআড়ি সড়ক নির্মাণ করা হয়। তারপর নদী দখল করে প্রথম পুকুর করেন চাকিরপশা ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান মীর ইসমাইল হোসেন। এ ছাড়া রাজারহাট সদর ইউনিয়নের পাঠানহাটে নদীর অন্তত ৪০ একর জমিতে ছয়টি পুকুর করেছেন উপজেলা কৃষক লীগের সাবেক সভাপতি মেজর অব,ইউনুছ আলী। ৩০ একর জমিতে বাড়িসহ তিনটি পুকুর প্রাচীর দিয়ে ঘিরে তিনি গড়ে তুলেছেন কৃষি খামার। সাত-আট একর আয়তনের দুটি পুকুরের মালিক চাকিরপশা ইউনিয়নের প্রয়াত চেয়ারম্যান মীর ইসমাইল হোসেনের নাতি ও বিএনপি নেতা হাবিবুল্লাহর ছেলে আহসান হাবীব। ছয় একর আয়তনের একটি পুকুর সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও রাজারহাট উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জাহিদ ইকবাল সোহরাওয়ার্দ্দীর পরিবারের দখলে রয়েছে। এ ছাড়া স্থানীয় কিছু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও রাজারহাটের মীর ইসমাইল হোসেন কলেজের বিরুদ্ধেও নদীর জমি দখল এবং পুকুর বানানোর অভিযোগ রয়েছে।
নদী নয়, বিল, এদিকে রাজারহাট উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জাহিদ ইকবাল সোহরাওয়ার্দ্দী বাপ্পী বলেন, চাকিরপশার কোনো নদী নয়, ঐতিহাসিকভাবে এটা একটা বিল। কেউ কেউ এটাকে নদী বলে প্রচার করছেন। এখানে ১০৯টি বাঁধ আছে। আমার পরিবারের একটি এবং আমার বড় ফুফার দুটি হোল্ডিং আছে। এগুলোর বৈধ কাগজপত্র আমাদের কাছে আছে। গত সপ্তাহে এ বিষয়ে প্রশাসন আমাদের চিঠি দিয়েছিল। আমরা সব কাগজপত্র প্রশাসনকে দিয়েছি। আইনানুগভাবে যা হবে, তা মেনে নেব। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এই বিলে মানুষজন, যার যার প্রয়োজনে রাস্তাসহ অনেক কিছু নির্মাণ করেছেন। ফলে পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। তবে পানির প্রবাহ শুরু হোক, এটা আমিও চাই। এ জন্য আমার পক্ষ থেকে সব রকম সহায়তা করা হবে।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার তিনি বলেন, চাকিরপশার এক সময় প্রবহমান নদী ছিল। রাস্তা নির্মাণ ও দখলের কারণে এটি এখন বিলে পরিণত হয়েছে। সরকার ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সহযোগিতায় নদী থেকে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ ও ইজারা বাতিল করে নদীটির জীবন্ত সত্তা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব।
এ বিষয়ে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের ছয়টি চিঠির বিষয়ে কিছু জানি না। তবে জেলা প্রশাসন থেকে ২২ জন দখলদারের তালিকা করা হয়েছে, সেই তালিকা প্রকাশ করা হয়নি। আগে আমরা চিহ্নিত করব কোন জায়গাগুলো অবৈধ। নদীর কোথায় কোথায় হোল্ডিং আছে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অনুসন্ধান করে জানা যায়, গত বছরের ৫ নভেম্বর, এ বছরের ৯ জানুয়ারি, ৫ মার্চ, ৪ আগস্ট, ৬ আগস্ট ও ১৭ ডিসেম্বর জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন নদীর অবৈধ দখল উচ্ছেদ ও অবৈধ বন্দোবস্ত বাতিলের জন্য ছয়টি চিঠি দেয়। এছাড়াও ভূমি মন্ত্রণালয় ২৩ আগস্ট কমিশনের নির্দেশনা পালনের সর্বশেষ অবস্থা জানতে চেয়ে একটি চিঠি দেয়। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সর্বশেষ চিঠিতে উল্লেখ রয়েছে, ২২ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্দেশনা পালন না করলে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের আদেশ বাস্তবায়নে অপারগতার দায় সংশ্নিষ্ট দপ্তরগুলোকে নিতে হবে।