বগুড়ায় ৮৪ কেজির প্রতিবস্তা আলু বিক্রি হচ্ছে ৯০টাকা থেকে ১২০ টাকা, ধরছে পচন
বগুড়া প্রতিনিধি, এম নজরুল ইসলাম, ৬ ডিসেম্বর, ২০১৭ (বিডি ক্রাইম নিউজ ২৪) : প্রতিটি হাট ও বাজারে সব ধরনের সবজির দাম বেড়েছে। আর এনিয়ে বিপাকে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। কিন্তু এবার কৃষকের বিধিবাম। আলুর বাজারে নেমেছে ধস। কোল্ডস্টোরে সংরক্ষনকৃত ৮৪ কেজির প্রতিবস্তা আলু বিক্রি হচ্ছে ৯০টাকা থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত। আলুর বাজারে ধস নামায় কৃষকরা দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০ বস্তা আলু কোল্ডস্টোরে পচে নষ্ট হওয়ায় কমমুল্যেও এই আলু কেউ নিতে চাচ্ছেন না বলে মন্তব্য করেছেন মজুদদাররা।
সূত্রমতে, বগুড়া অঞ্চলের আলুর আকৃতি ও মান ভালো। দেশের আলু উৎপাদনের অন্যতম প্রধান এলাকা বগুড়া জেলার আলুচাষি ও সংরক্ষণকারীরা বিপর্যয়ে পড়েছেন। প্রতি বস্তা আলুতে প্রায় ৪০০ টাকা থেকে ৫০০টাকা পর্যন্ত লোকসান হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জেলার শেরপুর উপজেলার শাহবন্দেগী ইউনিয়নের আয়রা গ্রামের কৃষক আজাদুর রহমান ও কুসম্বি ইউনিয়নের উতুলবাড়িয়া গ্রামের সেলিম রেজা।
খোজ নিয়ে জানা গেছে, বগুড়ায় ৬৬ হাজার হেক্টর জমিতে ১৪ লাখ মেট্রিকটন আলু উৎপাদিত হয়েছে। এরমধ্যে জেলার ৩৩টি হিমাগারে দুই লক্ষাধিক মেট্রিকটন আলু রয়েছে।
মঙ্গলবার নন্দীগ্রাম উপজেলা সদরের হাট-বাজার ঘুরে জানা গেছে, শীতকালীন সবজি খুব চড়া দামে বেচাকেনা চলছে। খুচরা মূল্যে বিক্রয় হচ্ছে প্রতিকেজি বেগুন ৪০টাকা থেকে ৬০ টাকা, টমেটো ৮০-৯০ টাকা, মুলা ৩০-৪০ টাকা, ফুলকপি ৭০-৯০ টাকা, কচুর বৈ ৩০-৪০ টাকা, ঢেঁড়স ৫০-৬০ টাকা, কাঁচামরিচ ৮০-১২০ টাকা, দেশি পিঁয়াজ ৮০-৯০ ও ভারতীয় পিঁয়াজ প্রতিকেজি ৫০-৬০ টাকা দামে বেচাকেনা হচ্ছে। সেখানে একই বাজারে পাকারি ও সাদা জাতের (কোল্ডস্টোরে সংরক্ষনকৃত) আলু বিক্রি হচ্ছে ১০-১৫ টাকা কেজি। অথচ কোল্ডস্টোরের মজুদদাররা বলছেন, সংরক্ষনকৃত ৮৪ কেজির প্রতিবস্তা আলু বিক্রি হচ্ছে ৯০টাকা থেকে ১২০ টাকা। তবে বাজারে নতুন আলু অনেক কমই এসেছে। সেগুলো বিক্রয় হচ্ছে ৪৫-৫০ টাকা কেজি।
নন্দীগ্রাম হাট-বাজারে আলু বিক্রয় করতে আসা আলু চাষি মুজিবুর রহমান, লোকমান হোসেন, আবেদ আলী ও গিয়াস উদ্দিন বিডি ক্রাইম নিউজ ২৪কে জানান, আলুর দাম কমে যাওয়ার কারণে তারা নজিরবিহীন লোকসানের মুখে পড়েছেন। বর্তমান দামে আলু বিক্রি করলে উৎপাদন খরচের টাকা তো দূরের কথা, পূজিও থাকবে না।
মজুদদাররা আলুর বাজারে ধস নামার বিষয়টি দাবি করলেও রনবাঘা বাজারের খুচরা কাঁচামাল ব্যবসায়ী আজমল হোসেন দাবি করে জানান, মহাস্থান বাজারে আলুর দাম কিছুটা কমেছে। আমি মহাস্থান হাট থেকে ৪শ’ টাকা বস্তা দরে আলু কিনে খুচরা ১০-১২ টাকা কেজিপ্রতি বিক্রয় করছি।
বগুড়া কৃষি আঞ্চলিক অফিস সূত্র বলছে, ২০১৬-১৭ কৃষি মৌসুমে উত্তরের চার জেলা বগুড়া, জয়পুরহাট, পাবনা ও সিরাজগঞ্জে আলুর চাষ হয়েছিল ১ লাখ ১৪ হাজার ১৬ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন হয়েছিল ২৩ লাখ ৫০ হাজার ২ মেট্রিক টন। চলতি মৌসুমে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে ১ লাখ ১০ হাজার ৪১০ হেক্টর জমি। ইতোমধ্যে চাষ হয়েছে ৪৭ হাজার ৩২৩ হেক্টর জমিতে। আগাম জাতের আলু উত্তোলন হয়েছে ১০০ হেক্টর। উৎপাদন প্রতি হেক্টরে ১৪ মেট্রিক টন।
কৃষি অফিস জানিয়েছে, গত মৌসুমে পর্যাপ্ত মজুদ এবং চলতি মৌসুমে নতুন আলু উত্তোলনের ফলে পুরানো আলু কোল্ডস্টোর থেকে নিচ্ছে না কৃষকরা। দাম না থাকায় কৃষকদের বস্তাপ্রতি লোকসান গুনতে হচ্ছে ১ হাজার ২শ’ টাকা থেকে ১৪শ’ টাকা। এক বস্তা লালশীল আলু মৌসুমে ক্রয় ও ভাড়াসহ খরচ হয়েছে ১৫৫০ টাকা, আর এ বছর তা বিক্রি হয়েছে কখনো ৬০০-৫০০-৪৫০-২০০ টাকায়। সম্প্রতি এক বস্তা আলু ৯০ টাকায়ও নিচ্ছেন না কৃষকরা। জেলার শাজাহানপুর ও শিবগঞ্জ উপজেলার প্রায় সবকটি কোল্ডস্টোরেই তিন ভাগের একভাগ আলু এখনো পড়ে আছে।
শিবগঞ্জের নিউ কাফেলা কোল্ডস্টোরেজের ক্যাশিয়ার আখতারুজ্জামান জানান, চলতি মৌসুমে ১ লাখ বস্তা আলু সংরক্ষণ করা আছে। এরমধ্যে ৭৪ হাজার বস্তা আলু কৃষক ও ব্যবসায়ীদের সরবরাহ করা হয়েছে। বাকি ২৬ হাজার বস্তা আলু ব্যবসায়ী ও কৃষক কেউ নিতে আসছে না। মজুদকৃত মোট আলুর ৫০ ভাগের বিপরীতে ব্যবসায়ী ও কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণও দেয়া আছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো কৃষক ও ব্যবসায়ী ঋণের টাকা পরিশোধ করেননি। প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০ বস্তা আলু পচে নষ্ট হচ্ছে। এগুলো বাছাই করছেন শ্রমিকরা। দাম কম থাকায় স্টোরগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহ সীমিত করা হয়েছে। এবার প্রতিটি কোল্ডস্টোরকেই লোকসান গুনতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি ।
অভিজ্ঞরা বলছেন, আলু নিয়ে কৃষকের এই বিপদ কয়েক বছর পরপরই দেখা দেয়। আলুর উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যদি আলু প্রক্রিয়াজাত কারখানার সংখ্যা ও রপ্তানি বাড়ানো যায়, তাহলে এ ধরনের সমস্যা এড়ানো সম্ভব। এজন্য সরকারকে আলুর বিষয়ে একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা নিতে হবে। বগুড়ার ৩৩ কোল্ডস্টোরে থাকা আলুতে প্রায় ১শ’ কোটি টাকার লোকসানের আশঙ্কা করছেন চাষিরা।