পাঁচ বছরেও আতঙ্ক কাটেনি, আজও মাঝরাতে ছোটাছুটি
বগুড়া প্রতিনিধি, এম নজরুল ইসলাম, 0৩ মার্চ, ২০১৮ (বিডি ক্রাইম নিউজ ২৪) : পাঁচ বছর আগে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ দিনের আতঙ্ক আজও মাঝরাতে অনেকের ঘুমের মাঝে দেখা দেয়। আজও ঘুমের মাঝে সেদিনের সেই ছোটাছুটি। ২০১৩ সালের ৩ মার্চ ‘কারাবন্দি মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীকে চাঁদে দেখার গুজব রটিয়ে বগুড়া সদরসহ জেলার দুপচাঁচিয়া, নন্দীগ্রাম, শাজাহানপুর, শিবগঞ্জ ও গাবতলী উপজেলার সরকারি অফিস, আওয়ামীলীগ নেতাদের অফিস-বাসভবন, উপজেলা চেয়ারম্যানের বাবভবন এবং সাধারন মানুষের দোকানপাটে তান্ডব-অগ্নিসংযোগ-লুটপাটের ঘটনা ঘটেছিল। সরকারি সব নথিপত্র পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
৩ মার্চ বগুড়াবাসীর জন্য এক ভয়ংকর ও আতংকের দিন। নারকীয় তান্ডব থেকে রেহাই পায়নি দোকানপাট অফিস-আদালত, থানা, পুলিশ ফাঁড়ি সহ কোন কিছুই। সেদিনের সেই নারকীয় তান্ডবে ২ শিশু সহ ১৩ জনের প্রাণও রক্ষা পায়নি। ৫ বছর আগের সেই দুঃসহ স্মৃতি আজও তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় এই জনপদের মানুষকে। বগুড়ার ইতিহাসে ৩ মার্চ এক কলঙ্কময় অধ্যায়ের নাম।
সেদিনের তান্ডবের বিষয়ে শনিবার (৩মার্চ) সন্ধ্যায় কথা হয় নন্দীগ্রাম উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান রেজাউল আশরাফ জিন্নাহ’র সাথে। সেদিনের সেই তান্ডবের সময় তার বাসভবনে ঘুমন্ত ছিলেন পরিবারের সবাই। হঠাৎ আগুনের তাপে ঘুম থেকে উঠে ছোটাছুটি। একদল মানুষ লাঠিসোটা নিয়ে সাবেক এই চেয়ারম্যানকে ধর-ধর আওয়াজ তুলে বাসভবনের দিকে ছুটে আসছিল। পরিবারের সবাইকে নিয়ে বাসভবন থেকে পালিয়ে রক্ষা পান সাবেক চেয়ারম্যান রেজাউল আশরাফ জিন্নাহ।
দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে মানবতা বিরোধী অপরাধে মৃত্যুদন্ডের রায় ঘোষনার পর জামাত-শিবির ৩ মার্চ রাত সাড়ে ৩টায় সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে বলে গুজব রটায়। জেলার অধিকাংশ মসজিদের মাইকে এমন গুজব ছড়িয়ে দিয়ে বগুড়া শহর সহ বিভিন্ন উপজেলায় একযোগে শুরু করে নাশকতা। হাজার হাজার শিশু, নারী-পুরুষ চারদিক থেকে লাঠি সোটা নিয়ে মিছিল সহকারে আসতে শুরু করে শহরের প্রানকেন্দ্র সাতমাথায়। এসময় তারা শহরের ৬টি পুলিশ ফাঁড়ি সহ নন্দীগ্রাম উপজেলা পরিষদ, শিবগঞ্জের মোকামতলা পুলিশ ফাঁড়ি, শাহাজানপুর থানা এবং দুপচাঁচিয়ার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে হামলা,ভাংচুর,অগ্নিসংযোগ লুটপাট চালায়।
অপরাধের ধরন দেখে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি দেশের মূল ভুখন্ড থেকে বগুড়াকে পৃথক করাই ছিল এমন পরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞের প্রধান উদ্দেশ্য ?
অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবেই সাধারণ মানুষের ধর্মীয় আবেগকে ব্যবহার করে ক্ষুব্ধ করে তোলে শিশু, কিশোর ও নারীসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষকে। উস্কানিতে রাস্তায় নেমে পড়ে নির্বোধ কিছু মানুষ। এরপর ধ্বংসযজ্ঞের সে কী ভয়াবহতা।
জামাত-শিবিরের পরিকল্পিত তান্ডবের পর রাস্তায় বেরিয়ে সাধারণ মানুষের বিস্ময়ের শেষ নেই। এ কী দশা একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন ভূমির ? যেন যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশের অংশ বিশেষ বগুড়া। ইট, পাথর, গাছ, গাছের গুড়ি, ইলেকট্রিক পোল, সিমেন্টের খুঁটিসহ নানা ধরনের জিনিস রাস্তায় ফেলে অচল করে দেওয়া হয় বগুড়াকে। ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বাদ পড়েনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রেলপথ, পুলিশ ফাঁড়ী ও থানা থেকে শুরু করে প্রায় সকল পর্যায়ের সরকারি-বেসরকারি কার্যালয়। রেহাই পাননি সাংবাদিক, শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি, ইউএনও’ও। সাধারণ মানুষ এই ঘটনার ৫ বছর পরেও ভুলতে পারেনি সেদিনের সেই নারকীয় ঘটনার কথা।
সেদিনের প্রত্যক্ষদর্শী তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার এ সার্কেল (বর্তমানে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ডিএসবি) মকবুল হোসেন জানান, ভোররাতে একজন সাংবাদিকের টেলিফোন পেয়ে তিনি বাড়ি থেকে বের হতেই দেখেন হাজার মানুষ লাঠিসোঠা হাতে নিয়ে শত শত মানুষ এগিয়ে আসছে। এই সময় থানার বিপরীত দিকে অবস্থিত পুলিশের বাস ভবন লক্ষ্য করে একটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এসময় তিনি এবং অপর সঙ্গীরা দ্রুত থানায় অবস্থান নেন। এরপর সদর থানা রক্ষা করতে তারা ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দেন। একই সময় বিভিন্ন দিক থেকে মানুষ আসতে থাকায় পুলিশ বাধ্য হয়ে গুলি চালায়। বিভিন্ন দিক থেকে আসা এই মানুষগুলো তাদের সামনে ছোট ছোট ছেলেদেরকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। যা অত্যন্ত অমানবিক।
বগুড়া জজকোর্টের পাবলিক প্রসিকিউটর এডভোকেট আব্দুল মতিন বলেন, এই ঘটনায় ৬৬টি মামলার চার্জশীট দেওয়া হলেও মাত্র ১১টি মামলার স্বাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। চলতি বছরের মধ্যে মামলাগুলো শেষ করা যাবে বলেও জানান তিনি।
বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও মিডিয়া সেল প্রধান সনাতন চক্রবর্তী জানান, ভবিষ্যতে এমন গুজব ছড়িয়ে কোন ধরনের নাশকতা কেউ যেন আর করতে না পারে তার জন্য পুলিশ সজাগ রয়েছে।