নীলফামারী ২০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ
নীলফামারী প্রতিনিধি, মো. শাইখুল ইসলাম সাগর, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১ (বিডি ক্রাইম নিউজ ২৪) : নীলফামারীতে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত সরকার প্রায় ২০কোটি টাকা আত্মসাৎ অভিযোগ ওঠেছে দুই ব্যাংক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও ঠিকাদারের ছত্রছায়ায় ব্যাংক গ্যারান্টির সিকিউরিটির টাকা আত্মসাতসহ সেচ্ছাচারিতার অভিযোগ উঠেছে স্টান্ডার্ড ব্যাংক ও পূবালী ব্যাংক নীলফামারী শাখা ব্যবস্থাপকের বিরুদ্ধে। এতে উদ্যোক্তা ও উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়নকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো সর্বশান্ত হয়েছে। সেই সাথে ব্যাংক গুলো আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার পাশাপাশি রাজস্ব হারিয়েছে সরকার। ২০১৬-১৭ ও ১৮-১৯ অর্থ বছরের এসব অনিয়মের তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এর মধ্যে স্টান্ডার্ড ব্যাংক চার বছর আর পূবালী ব্যাংকে ঘটেছে তিন বছর ধরে এমন ঘটনা।
নীলফামারী চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক ও বিশিষ্ট ঠিকাদার মোফাক্কারুল হোসেন মামুনের দূর্নীতি দমনে দায়ের করা অভিযোগ থেকে জানা যায়, রংপুর বিভাগ উন্নয়ন প্রকল্পের (আরডিআরআই আইপিটু) আওতায় ১০৭ কোটি টাকা ব্যয়ে দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ হয়। এর মধ্যে ১২ কোটি ১৯ লাখ ২৪ হাজার ৬৮৮ দশমিক ৩৩ টাকার কাজ পায় জেভি অব কেই.এস.এ.এসবি এ নর্দাণ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। নীলফামারী-জলঢাকা আরএসডি রোড এড কচুকাটা বন্দর থেকে ডোমার আরএসডি রোড ভায়া রামগঞ্জ বন্দর পর্যন্ত ১৪ দশমিক ৭৭০ কিলোমিটার সড়ক পাকাকরণ ও সংস্কার কাজ (টেন্ডার আইডি ২৬৭৪১) বাস্তবায়ন করে ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে স্বত্তাধিকারী এসএম সফিকুল ইসলাম ডাব্লু।
প্রকল্পের কাজের ৮০ শতাংশ শেষ হবার পর অর্থলগ্নি পার্টনার হিসেবে মোফাক্কারুল হোসেন মামুনকে সমস্ত কাজের ব্যাংক গ্যারান্টির জামানতের টাকা ও কাজের বিলের ক্ষমতা হস্তান্তরসহ এনওসি প্রদান করেন ঠিকাদার এসএম সফিকুল ইসলাম ডাব্লু। যার দালিলিক প্রমাণস্বরুপ নোটারী পাবলিকে এফিডেফিট করা হয়। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হলে ২০২১৭ সালের ১৪ মার্চ ব্যাংক গ্যারান্টির মেয়াদ বর্ধিত করা হয় স্টান্ডার্ড ব্যাংকে। তবে কাজ শেষে ঠিকাদার মোফাক্কারুল হোসেন মামুন তার ব্যাংক গ্যারান্টির জামানতের টাকা ফেরত নিতে গেলে ব্যবস্থাপক মোস্তফা জামান তা দিতে ব্যর্থ হন। প্রকল্পের একটি ব্যাংক গ্যারান্টি (যার টেন্ডার আইডি নম্বর ২৬৭৪১, মোট টাকার পরিমান ২৪ লাখ ৩৮ হাজার ৯৯৪) স্টার্ন্ডাড ব্যাংক নীলফামারী শাখায় জমা করা হলেও ব্যাংক গ্যারান্টির বিপরীতে জামানত (মার্জিন) সমুদয় টাকা ফেরত দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন ব্যাংক ব্যবস্থাপক। শর্ত জুরে দেন মোফাক্কারুল হোসেন মামুনের নিজ নামিয় বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের ১৬টি গ্যারান্টি অন্য ব্যাংকে স্থান্তরিত করার। তবেই তিনি জামানতের টাকা ফেরত পাবেন।
পরবর্তীতে এই ১৬টি ব্যাংক গ্যারান্টির সময়সীমা থাকলেও ঠিকাদার মোফাক্কারুল হোসেন মামুন নতুনভাবে পূবালী ব্যাংক ও মার্কেন্টাইল ব্যাংক নীলফামারী শাখায় স্থানান্তরিত করলেও ব্যাংক গ্যারান্টির বিপরীতে জামানতের ওই টাকা ফেরত দেওয়া হয়নি তাকে। এছাড়া ওই কাজের ঠিকাদার মোফাক্কারুল হোসেন মামুনকে অস্বীকার করে তাকে এসএম সফিকুল ইসলাম ডাব্লু এর মাধ্যমে আসতে বলেন। পরবর্তীতে ঠিকাদার এসএম সফিকুল আলমের সাথে যোগাযোগ করে বিভিন্ন সময়ে মাত্র ২০ লাখ টাকা ফেরত পান মোফাক্কারুল হোসেন মামুন। কিন্তু অবশিষ্ট সাড়ে ১৫ লাখ টাকা ব্যাংক ব্যবস্থাপকের কাছ থেকে নিতে বলেন।
এদিকে ঠিকাদার মামুনকে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর আই.আর.আই.ডিটি (২) প্রকল্পের আওতায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৫৭ লাখ ৮১ হাজার ৭৫০ টাকা ব্যয়ে একটি উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়নের বিপরীতে আরো ১৫টি কাজসহ ১৬ ব্যাংক গ্যারান্টি বাবদ ১৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা প্রদানের আগেই স্টান্ডার্ড ব্যাংক ব্যবস্থাপক মোস্তফা জামানকে ঢাকায় বদলী করা হয়। পরবর্তীতে তিনি মোফাক্কারুল হোসেন মামুনের সাথে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেন এবং স্টান্ডার্ড ব্যাংকের চাকুরিও ছেড়ে দেন। পরে যমুনা ব্যাংকে যোগদান করলে ব্যবস্থাপক হিসেবে তাকে পোস্টিং দেওয়া হয় নীলফামারীর জলঢাকা শাখায়। খবর পেয়ে সেখানে মোফাক্কারুল হোসেন মামুন টাকার বিষয় নিয়ে কথা বললে তিনি তা এরিয়ে যান।
অভিযোগ নিয়ে ব্যবস্থাপক মোস্তফা জামানের সাথে কথা হলে তিনি পুরো বিষয়টি অস্বীকার করেন। জানান, তার সময়কালে মোফাক্কারুল হোসেন মামুন নামে স্টার্ন্ডাড ব্যাংক নীলফামারী শাখায় কোন গ্রাহক ছিল না। ব্যাংক গ্যারান্টি দেওয়ার প্রশ্নই আসেনা। তবে নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক একাধিক সূত্র জানিয়েছে, মোস্তফা জামান স্টান্ডার্ড ব্যাংকে থাকা অবস্থায় ভূয়া ব্যাংক গ্যারান্টি, নন এমআইআর পে-অর্ডার ব্যবহার করে ত্রাণ মন্ত্রনালয় ও এলজিইডির বাস্তবায়ন কাজে পারফর্মেন্স সিকিউরিটি (পিজি) ও (বিজি) বিট সিকিউরিটির প্রায় ২০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এতে রাজস্ব হারিয়েছে সরকার। মুনাফা থেকে বঞ্চিত হয়েছে ব্যাংক এবং আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে পথে বসেছেন ঠিকাদাররা।
শুধু স্টান্ডার্ড ব্যাংকই নয়, চক্রটি বড় পরিসরে মাঠে নামেন ব্যাংক ও স্থানীয় বেশ কিছু ঠিকাদারকে সর্বশান্ত করতে। চোখ পরে তাদের পূবালী ব্যাংক নীলফামারী শাখার ওপর। ২০১৯ সালে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান নয়েল এন্টার প্রাইজের স্বত্তাধিকারী মনিরুল ইসলাম সুইডেন’র জামানতের বিপরীতে ব্যাংক গ্যারান্টির ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা ঠিকাদার মোফাক্কারুল হোসেন মামুনের পুবালী ব্যাংক শাখায় জমা করা হয়। কিন্তু ব্যাংক গ্যারান্টির মেয়াদ শেষ হলেও মার্জিনের ১০ শতাংশের টাকা ব্যবস্থাপক রবিউল ইসলাম একাউন্টে জমা না রেখে নিজের কাছে রেখে দেন। এতে মামুনের সন্দেহ হলে তিনি ব্যাংক গ্যারান্টির বিষয়টি জাল বলে প্রমাণ পান। এর পরেও সেই টাকা ফেরত না দিয়ে ব্যবস্থাপক আত্মসাৎ করেন। অথচ মোফাক্কারুল হোসেন মামুন এই শাখার একজন সনামধন্য গ্রাহক। তার লিমিট প্রায় চার কোটি টাকা, যা এই শাখার সর্বোচ্চ ঋণ গ্রহীতা। অথচ এই সনামধন্য ব্যবসায়ীকে নানাভাবে সর্বশান্ত করা হয়েছে।
মোফাক্কারুল হোসেন মামুন জানান, মানবিক আচরণসহ চাপ প্রয়োগ করলে মার্জিনের কিছু টাকা তাকে ফেরত দেওয়া হয়। এরপর তার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকার পে-অর্ডার ক্যাশ করে ব্যাংক একাউন্টে রেখে দেন ব্যবস্থাপক রবিউল ইসলাম।
এছাড়া তার একাউন্ট থেকে কয়েকটি পে-অর্ডারের দুই লাখ ৮০ হাজার টাকা অন্য এক গ্রাহককে দেওয়া হয়। যা ব্যাংকিং আইন বহির্ভূত। এছাড়া অন্য একটি কাজের বিপরীতে ৩০ লাখ টাকা অনুমোদন হলেও নগদ ক্যাশ না করে অদৃশ্য কারণে অনুমোদন আটকে রাখা হয়। বিষয়টি ব্যাংকের ডিজিএমকে অবগত করা হলে ২০ দিন পর কয়েক দফায় পুরো টাকা দিতে বাধ্য হন ব্যবস্থাপক রবিউল। তিনি আরও জানান, এতে উপঢৌকন হিসেবে ব্যবস্থাপক রবিউল দিনাজপুরে বাড়ি তৈরিতে তার ইটভাটা থেকে ৫৭ হাজার ইট জোরপূর্বক আদায় করেন। টাকার অংকে যার মূল্য চার লাখ ৫৬ হাজার। এছাড়া হাওলাতের নামে আরো সাত লাখ টাকা হাতিয়ে নেন তিনি। রবিউল ইসলামের সময়কালে নানাভাবে তার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় চার কোটি টাকা। এতে করে তিনি মানসিকভাবে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন।
এসব বিষয় নিয়ে পূবালী ব্যাংকের আঞ্চলিক শাখায় লিখিত অভিযোগ করলে রবিউল ইসলামের সব অনিয়মের অভিযোগ ক্ষতিয়ে দেখতে ব্যাংকের ডিজিএম কামরুজ্জামান একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। তদন্তে তার সব ধরনের অপকর্ম, অনিয়ম-দূনীতি ও সেচ্ছাচারিতার প্রমাণ মিললেও ব্যবস্থাপক রবিউল ইসলাম নীলফামারী শাখায় চার বছর সম্পন্ন করে জেলার সৈয়দপুর শাখায় ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করছেন বহাল তবিয়তে।
মোফাক্কারুল হোসেন মামুন দাবি করে বলেন, ব্যবস্থাপক রবিউল ইসলামের দিনাজপুরে নব-নির্মিত দ্বিতল বাড়িটির দেওয়াল ভেঙে ফেললেই দূর্নীতির সব চিত্র বেরিয়ে আসবে। এমনকি টাইলস, ইলেক্ট্রিক সামগ্রী, থাই এ্যালোমেনিয়ামসহ আরো নানা সামগ্রী নীলফামারী থেকে নিয়ে যাওয়ার প্রমাণও মিলবে। নীলফামারীর আরো অনেক ঠিকাদার ওই সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়ে সর্বশান্ত হয়েছেন বলেও জানান তিনি।
সাবেক স্টান্ডার ব্যাংক ও বর্তমান জলঢাকা শাখার যমুনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপক মো. মোস্তফা জামান বলেন, ৫বছর আগের ঘটনা, কেন যে বিষয়টি নিয়ে বারবারি করছে। তা আমার জানা নেই। টাকা আত্মসাৎ বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি কৌশলে এড়িয়ে যান।
অপর ব্যবস্থাপক রবিউল ইসলাম বলেন, নীলফামারীতে থাকাকালীন সময়ে তার ব্যাংকের বড় মাপের গ্রাহক ছিলেন মোফাক্কারুল হোসেন মামুন। অনেক বার টাকা লেনদেন করেছেন। তিনি বলেন, ‘ব্যাংকে আমার বিরুদ্ধে অনিয়ম সংক্রান্ত তদন্ত হয়েছে ঠিকই, তবে ঠিকাদার মামুনের সাথে ব্যক্তিগত লেনদেন এবং অনিয়ম-দূর্নীতির বিষয়টি ঠিক নয়।
এ ব্যাপারে মোফাক্কারুল হোসেন মামুন প্রতিকার চেয়ে দুদক ও নীলফামারী চেম্বার অব কর্মাস বরাবর লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।