দেবিদ্বারে ছোট ভাই কর্তৃক নেশাগ্রস্ত বড় ভাই খুন
কুমিল্লা (দেবিদ্বার) প্রতিনিধি, জি এম মাকছুদুর রহমান, ২৫ জুন, ২০১৮ (বিডি ক্রাইম নিউজ ২৪) : দেবীদ্বারে মাদকের টাকার জন্য পিতাকে কুপিয়ে হত্যাকারী সেই মাদকাসক্ত সোহেল রানা (২৮) কে অতিষ্ট হয়ে জবাই করে হত্যা করল তার মেঝোভাই মেহেদী হাসান (২২)। পুলিশ হত্যাকান্ডের ৪ ঘন্টার মধ্যেই হত্যাকারীকে সনাক্ত করে আটক করেন। জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকান্ডের বর্ননা দিলেন ডেকোরেটর ব্যবসায়ি নিহতের মেঝো ভাই মেহেদী হাসান।
ওই ঘটনায় নিহতের ছোট ভাই হাফেজ এমরান বাদী হয়ে রোববার দুপুরে মেহেদী হাসানকে একমাত্র আসামী করে দেবীদ্বার থানায় মামলা দায়ের করেছেন। এর আগে ২০১৫ সালের ১০ জানুয়ারী নেশার টাকার জন্য তার বাবা ইউনুছ মিয়াকে পুত্র সাহেল রানা কুপিয়ে হত্যা করেছিল।
সম্প্রতি নিহতের বড়ভাই সুমন মিয়া(৩০) ও মাদক সেবনের দায়ে ভ্রাম্যমান আদালতের রায়ে ৬মাসের সাজায় কারাগারে রয়েছেন। পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, রোববার সকাল সোয়া ৬টায় পৌর এলাকার মরিচাকান্দা গ্রামে নিজ বাড়ির পাশে সোহেল মিয়ার লাশ গলাকাটা অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয়রা থানা পুলিশকে খবর দেয়।
খবর পেয়ে দেবীদ্বার থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) সরকার আব্দুল্লাহ আল মামুন, উপ-পরিদর্শক (এসআই) আসাদুল ইসলাম, উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোর্শেদ আলম, উপ-পরিদর্শক (এসআই) প্রেমধন মজুমদার সহ টিম দেবীদ্বার দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌছে ভিকটিম সোহেল রানা (২৭)’র মৃতদেহ রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে তার পরিবারের লোকজনের মাধ্যমে লাশ সনাক্ত করেন।
ঘটনাস্থলে পৌছে উপ-পরিদর্শক (এসআই) আসাদুল ইসলাম লাশের সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুত করে লাশের ময়নাতদন্তের জন্য কুমিল্লা মেডিকেল হাসাপাতাল মর্গে প্রেরন করেন। নিহত সোহেল রানা পৌর এলাকার মরিচাকান্দা গ্রামের বাদু মিয়া বাড়ির মৃত: ইউনুছ মিয়ার দ্বিতীয় পুত্র। পুলিশ হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত সন্দেহে নিহতের সেজো ভাই ডেকোরেটর ব্যবসায়ি মেহেদী হাসান (২৩) কে আটক করে এবং জিজ্ঞাসাবাদে মেহেদী হাসান হত্যাকান্ডের বর্ননা দেন।
ওই ঘটনায় নিহতের ছোট ভাই হাফেজ এমরান বাদী হয়ে মেহেদী হাসানকে একমাত্র আসামী করে একটি এজহার দায়ের করেছেন। উক্ত এজাহারের ভিত্তিতে দেবীদ্বার থানার মামলা নং-১৫, তারিখ-২৪/০৬/১৮ খ্রিঃ ধারা-৩০২ পেনাল কোড রুজু করে উক্ত মামলার তদন্তভার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) সরকার আব্দুল্লাহ আল মামুনের উপর ন্যাস্ত করা হয়।
পুলিশ জানায়, ভিকটিমের ছোট ভাই মেহেদী হাসান’র আচার আচরনে সন্দেহ হওয়ায় মেহেদী হাসান (২৩) কে ঘটনার বিষয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে মেহেদী হাসান হত্যা কান্ডের দায় স্বীকার করে জানায় যে, ভিকটিম সোহেল রানা (২৭) দীর্ঘদিন যাবত মাদকাসক্ত। সে মাদকাসক্তির কারনে গত ১০/০১/১৫ ইং তার বাবা ইউনুস মিয়া কর্তৃক বাঁধা প্রাপ্ত হয়ে তার পিতা কে কুপিয়ে হত্যা করে।
এ ঘটনায় উক্ত ভিকটিমের বিরুদ্ধে দেবীদ্বার থানার মামলা নং-১৭, তারিখ-১০/০১/১৫ ইং, ধারা-৩০২ পিসি রুজু হয়। এ হত্যা মামলায় ভিকটিম সোহেল রানা প্রায় দেড় বছর পরে জামিনে মুক্ত হয়ে পুনরায় মাদক সেবন শুরু করে। মাদক ক্রয়ের টাকার জন্য ভিকটিম সোহেল রানা তার পরিবারের লোকজনের উপর প্রতিনিয়ত অন্যায় অত্যাচার করতে থাকে।
গত ৩০/০৫/১৬ ইং ভিকটিম সোহেল রানা মাদক সেবন করে তার মাকে মারধর করায় মোবাইল কোর্ট মামলা নং-৫২/১৬, ধারা-১৯৯০ সনের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন আইনের ১৯ (১) এর ৭(ক) মূলে ভিকটিম সোহেলকে ০৬ মাসের বিনাশ্রম কারাদন্ড প্রদান করা হয়। উক্ত ০৬ মাসের কারাদন্ড ভোগ শেষে বাড়ীতে এসে প্রায় ০১ মাস স্বাভাবিক থাকার পর পুনরায় মাদক সেবনে অভ্যাস্ত হয়ে পড়ে এবং পরিবারের উপর পূর্বের ন্যায় অত্যাচার শুরু করলে ভিকটিম সোহেল রানার নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে তার মা দেবীদ্বার থানা পুলিশের সহায়তায় তাকে মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে প্রায় ০৩ মাস চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।
চিকিৎসা শেষে কিছুদিন স্বাভাবিক থাকলেও সে পুনরায় মাদক সেবনে অভ্যাস্ত হয়ে পড়ে এবং পূর্বের ন্যায় তাহার পরিবারের লোকজনের উপর অন্যায় অত্যাচার করতে থাকে। এতে ভিকটিমের পরিবারের একমাত্র উর্পাজনক্ষম তার ছোট ভাই মেহেদী হাসান (২২) ভিকটিমের অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে গতকাল রাত অনুমান ৩ টায় ভিকটিমের বসত ঘরের দক্ষিন দিকের টয়লেট সংলগ্ন খালি ভিটি জায়গায় ভিকটিমকে মাদক সেবনরত অবস্থায় একা পেয়ে পরিকল্পনামতে লোহার রড দিয়ে ভিকটিমের মাথায় আঘাত করে।
মাথায় লোহার রডের আঘাতে ভিকটিম মাটিতে লুটিয়ে পড়লে মেহেদী হাসান তার হাতে থাকা ক্ষুর ও ছুরি দিয়ে পেটে, গলায় ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে পোচ দিয়া হত্যা করে। হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত ক্ষুর এবং লোহার রড ঘটনাস্থলে পার্শ্ববর্তী পুকুরে ফেলে দেয় এবং হত্যা কান্ডে ব্যবহৃত ছুরিটি তার মালিকানাধীন দোকানের (নিউ সুরভী ডেকোরেটর, মরিচাকান্দা মসজিদ মার্কেট) ভিতরে ক্যাশ বক্সে রাখে এবং ভিকটিমকে হত্যার পর তার পরিহিত গেঞ্জি ও প্যান্টে রক্ত লেগে যাওয়ায় রক্ত মাখা কাপড় ছোপড় ধুয়ে পরিষ্কার করে তার দোকানের ভিতরে রেখে দেয়।
আসামীর স্বীকারোক্তি ও দেখানোমতে তার ডেকরেটরের দোকানের ক্যাশ বক্সে থাকা হত্যা কান্ডে ব্যবহৃত কাঠের বাটযুক্ত অনুমান ১৩.৫” লম্বা ষ্টিলের ধারালো ছুরি এবং ধুয়ে ফেলা কাপড় ছোপড় উদ্ধার করা হয়। মেহেদী হাসান ক্ষোভের সাথে জানান, নেশাগ্রস্থ সোহেল পরিবারের শান্তি, সম্মান এমনকি পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যাক্তি আমাদের পিতাকেও নেশার টাকার জন্য হত্যা করেছে।
সোহেলকে মাদক আইনে এবং পিতাকে হত্যার অভিযোগে করাগারে পাঠালেও কারাগার থেকে একবছর পূর্বে বেড়িয়ে এসে আবারো নেশার জগতে চলে যায়। মাকেও নেশার টাকার জন্য মারধর করত। পিতার অবর্তমানে মেহেদী হাসান ডেকোরেটরের ব্যবসা দিয়ে সংসারের হাল ধরেন। এব্যবসাতেও সোহেলের নেশার টাকার চাঁপে মেহেদী হাসান অতিষ্ঠ হয়ে উঠে।
শনিবার দিবাগত রাতে সোহেলকে পুকুরপাড়ে নেশাগ্রস্থ অবস্থায় দেখে মেহেদী হাসান প্রথমে রড দিয়ে মাথায় আঘাত করে অচেতন করে, পরে ছুরি দিয়ে তার গলা কেটে এবং বিভিন্ন অংশে আঘাত করে হত্যা করে। পরে বাড়ির পাশে লাশ ফেলে আসে। পরনের রক্তাক্ত কাপড় ও ছোরাটি ধুয়ে ডেকোরেটর দোকানে রেখে মেহেদী বাড়িতে এসে ঘুমিয়ে থাকে। পুলিশ আলামত হিসেবে হত্যাকারীর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্ধীতে ডেকোরেটর দোকানে রক্ষিত ছোরা ও রক্তেভেজা কাপড়গুলো উদ্ধা করেছে।
পৌরসভার সহায়তা কমিটির স্থানীয় ওয়ার্ড সদস্য আব্দুল কাদের জানান, সোহেল মিয়া দীর্ঘ দিন ধরে মাদকাসক্ত, ২০১৫ সালের ১০জানুয়ারী নেশার টাকার জন্য তার বাবাকেও সে কুপিয়ে হত্যা করেছিল। সে মাদক মামলায় কয়েক বছর জেল খাটার পর জামিনে ছিল। তার আরেক ভাইও মাদকের মামলায় জেলে ৬মাসের সাজা ভোগ করছে।
এ ব্যাপারে দেবীদ্বার থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ মিজানুর রহমান ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে জানান, পুলিশ সকাল সাড়ে ৭টায় ঘটনাস্থল থেকে নিহতের লাশ উদ্ধার পূর্বক ময়না তদন্তের জন্য কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে প্রেরন করা হয়েছে। নিহতের ছোট ভাই হাফেজ এমরান বাদী হয়ে মেহেদী হাসানকে একমাত্র আসামী করে মামলা দায়ের করেছেন। তবে নেশার কারনে একটি সুন্দর পরিবার ধ্বংস হয়ে গেল।