বাংলাদেশের খ্রিস্টান সম্প্রদায়
ঢাকা, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, (বিডি ক্রাইম নিউজ ২৪) :
খ্রিস্টান সম্প্রদায়
ঈশ্বর পুত্র প্রভু যীশু খ্রিস্টের যাঁরা অনুসারী তাঁদেরকেই খ্রিস্ট বিশ্বাসী বা খ্রিস্টান বলা হয়। খ্রিস্টানগণ যীশু খ্রিস্টের আর্দশ এবং তাঁর প্রদর্শিত পথকে অনুসরণ করেন। যীশু খ্রিস্টের আর্দশ, শিক্ষা এবং প্রদর্শিত পথ সম্পর্কে পবিত্র বাইবেলে বিস্তারিত বলা হয়েছে। পবিত্র বাইবেল খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ। যীশু খ্রিস্ট এখন থেকে ২০১২ বৎসর আগে এই পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। বর্তমানে সারা পৃথিবীতে ২৩১ কোটির অধিক মানুষ খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসী। বাংলাদেশে খ্রিস্টান জনগণের সংখ্যা ৫ লক্ষাধিক এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ইতিহাস চারশত বৎসরের অধিক। এদেশের জনপদেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ এই খ্রিস্টান সম্প্রদায়। এদেশেরই আলো, বাতাস এবং মাটিতে তাদের জন্ম, বেড়েওঠা এবং বসবাস। ইউরোপ, আমেরিকা বা অন্যকোন দেশ থেকে আসা মানুষ তাঁরা নয়।
বঙ্গদেশে খ্রিস্টধর্মের গোড়াপত্তন
ঐতিহাসিকভাবে জানা যায় যীশু খ্রিস্টের ১২ জন শিষ্যের অন্যতম সাধু টমাস ৫২ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ ভারতে আসেন এবং ৭২ খ্রিস্টাব্দে তিনি সেখানে সাক্ষ্যমর বা ধর্মশহীদ হন। এ সময়ের মধ্যে তিনি স্থানীয় কিছু ইহুদী, অগ্নিউপাসক ও সনাতনধর্মে বিশ্বাসী ব্যক্তিবর্গকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করেন। তিনি ভারতের দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলে ৭টি গির্জা স্থাপন করেন বলেও জানা যায়।
পর্তুগীজদের আগমন ও খ্রিস্টধর্মের বিস্তার
উত্তমাশা অন্তরীপ প্রদক্ষিণ করে ভাস্কো-দা-গামা ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতে পর্তুগীজ আধিপত্যের গোড়াপত্তন করেন। পর্তুগীজ বসতিস্থাপনকারী ও ব্যবসায়ীদের সাথে ভারতে খ্রিস্টান মিশনারীদের আগমন ঘটে। ১৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগীজরা বর্তমান ভারতের হুগলীর নিকটবর্তী সাতগাঁও ও চট্টগ্রামে বসবাস ও শুল্কগৃহ নির্মাণের অনুমোদন লাভ করেন। ১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দে মোঘল সম্রাট আকবর তাঁদেরকে বঙ্গদেশে স্থায়ী বসতি স্থাপন ও গির্জা নির্মাণের অনুমতি দেন। পর্তুগীজ বসবাসকারীরাই হলেন বাংলার প্রথম খ্রিস্টান, প্রথম দেশীয় খ্রিস্টানরা হলেন তাদের বংশধর এবং পরবর্তীতে ধর্মান্তকরণের মাধ্যমে খ্রিস্টান জনগণের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশে ক্যাথলিক মন্ডলীর বয়সকাল ৪০০ বৎসরেরও অধিক। অপরদিকে প্রটেস্ট্যান্টমন্ডলী সমূহের বয়স ২০০ বৎসরেরও কিছু বেশী সময়কাল।
বাংলাদেশের বর্তমান সাতক্ষীরা জেলার অর্ন্তগত চান্দিকান বা ঈশ্বরীপুরে ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে প্রথম একটি ক্যাথলিক গির্জা নির্মিত হয়, যার নাম ÔHoly Name of Jesus’. ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের ২৪ শে জুন দ্বিতীয় গির্জাটি নির্মিত হয় চট্টগ্রামে যার নাম ‘Saint John the Baptist Church’. ১৬১২ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় প্রথম পর্তুগীজ আগষ্টিনিয়ান পুরোহিতগণ খ্রিস্টধর্মের প্রচার শুরু করেন। ১৬২৮ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার নারিন্দায় একটি গির্জা নির্মিত হয় যার নাম রাখা হয় ‘Church of the Assumption’. ঢাকার ঐতিহাসিক তেজগাঁও গির্জা ১৬৭৭ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয়। এছাড়া বর্তমান গাজীপুর জেলার নাগরীতে ১৬৯৫ খ্রিস্টাব্দে, ঢাকার নবাবগঞ্জের হাসনাবাদে ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে এবং বরিশালের পাদ্রীশিবপুরে ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে একটি করে গির্জা নির্মিত হয়েছিল।
১৬৬০ খ্রিস্টাব্দ থেকেই পর্তুগীজ মিশনারীরা বাংলাদেশের শিক্ষা, সভ্যতা ও সামাজিক অবস্থার ভিত্ প্রস্তুত করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে থাকেন। ১৬৬৩-১৮৩৪ সাল পর্যন্ত বঙ্গদেশে খ্রিস্ট ধর্মের উল্লেখযোগ্য সম্প্রসারণ ঘটে। ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে সাতক্ষীরা জেলার ঈশ্বরীপুরে জেটুইট মিশনারীদের দ্বারা নির্মিত প্রথম গির্জাটির ধ্বংসাবশেষ এখনো বিদ্যমান আছে।
বাংলাভাষা ও বাঙ্গালী জাতির শিক্ষার ক্ষেত্রে যে মিশনারী মনীষীর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে আছে তাঁর নাম ড. উইলিয়াম কেরী। ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের কলিকাতায় আসেন। ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি অবৈতনিক দৈনিক পাঠশালা খুলেন এবং হিন্দু ও মুসলমান যুবকদের জন্য মদনাবটিতে ১টি ও রামপাল দীঘিতে ১টি কলেজ স্থাপন করেন। তিনি ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে পবিত্র বাইবেলের নতুন নিয়মের গদ্য অনুবাদ করেন। ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি পবিত্র বাইবেলের পুরাতন ও নতুন নিয়ম বাংলায় অনুবাদ করেন ও তা মুদ্রণ করেন।
ড. কেরী ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুরে একখান ছাপাখানা স্থাপন করেন ও ছাপার মান উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখেন। তিনি শ্রীরামপুরে একটি কলেজও স্থাপন করেন। তাঁর কর্মজীবন অবিভক্ত ভারতে খ্রিস্টধর্মের আলো প্রবর্তনের এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। ড. কেরী ছিলেন প্রটেস্ট্যান্ট মন্ডলীর একজন নিবেদতি প্রাণ প্রচারক।
১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে Baptist Missionary Society (British),, ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে Church Missionary Society (British), ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে Council for World Mission (British Pressbyterian) প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের স্বাধীনতা যুদ্ধোত্তর প্রটেস্ট্যান্ট মন্ডলী সমূহের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।
বাংলাদেশের ক্যাথলিক মন্ডলী
‘ক্যাথলিক’ শব্দের অর্থ ‘সার্বজনীন’ এবং ‘মন্ডলী’ অর্থ জনগণের সমাহার বা চার্চ। ক্যাথলিক মন্ডলী বলতে বুঝায় ‘সার্বজনীন চার্চ’। ক্যাথলিক মন্ডলী হল বিশ্বের মূলধারার খ্রিস্টিয় সমাজ। পুণ্যপিতা পোপ হলেন বিশ্বের ক্যাথলিক মন্ডলীর প্রধান ধর্মগুরু। বিশ্বের ক্যাথলিক মন্ডলী পরিচালনার কেন্দ্রস্থল হল ইতালীর রোম নগরীর সার্বভৌম ভ্যাটিক্যানসিটি। মহামান্য ষোড়শ বেনেডিক্ট হলেন বর্তমান পোপ। বর্তমানে বাংলাদেশের ক্যাথলিক মন্ডলী ৭টি ধর্মপ্রদেশে (উরড়পবংব) বিভক্ত। বাংলাদেশের খ্রিস্টান জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই এই ক্যাথলিক মন্ডলীর অন্তর্ভুক্ত।
ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশ : ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকা ধর্মপ্রদেশ গঠিত হয়। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জুলাই ঢাকা-কে মহাধর্মপ্রদেশের মর্যাদা দেয়া হয়। এ মহাধর্মপ্রদেশের বর্তমান আর্চবিশপ হলেন পরম শ্রদ্ধেয় প্যাট্রিক ডি’ রোজারিও সিএসসি। এছাড়াও সহকারী বিশপ হিসেবে আছেন শ্রদ্ধেয় থিওটোনিয়াস গমেজ, সিএসসি।
চট্টগ্রাম ধর্মপ্রদেশ : ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে চট্টগ্রাম ধর্মপ্রদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে এ ধর্মপ্রদেশের বিশপ হচ্ছেন শ্রদ্ধেয় মজেস মন্টু কস্তা, সিএসসি । সহকারী বিশপ হিসেবে রয়েছেন শ্রদ্ধেয় লরেন্স সুব্রত হাওলাদার, সিএসসি।
দিনাজপুর ধর্মপ্রদেশ : ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে এই ধর্ম প্রদেশ স্থাপিত হয়। এ ধর্মপ্রদেশের বর্তমান বিশপের নাম শ্রদ্ধেয় সেবাষ্টিয়ান টুডু।
খুলনা ধর্মপ্রদেশ : ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জানুয়ারী এ ধর্মপ্রদেশ স্থাপিত হয়। এ ধর্মপ্রদেশের বর্তমান বিশপের নাম শ্রদ্ধেয় রমেন বৈরাগী।
ময়মনসিংহ ধর্মপ্রদেশ : ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দের ৮ সেপ্টেম্বর এ ধর্মপ্রদেশ স্থাপিত হয়। এ ধর্মপ্রদেশের বিশপ হচ্ছেন শ্রদ্ধেয় পনেন পল কুবি, সিএসসি।
রাজশাহী ধর্মপ্রদেশ : ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর এ ধর্মপ্রদেশ স্থাপিত হয়। এ ধর্মপ্রদেশের বিশপ হচ্ছেন শ্রদ্ধেয় জের্ভাস রোজারিও।
সিলেট ধর্মপ্রদেশ : ২০১১ খ্রিস্টাব্দের ৮ জুলাই এই ধর্মপ্রদেশ গঠিত হয়। বর্তমানে এ ধর্ম প্রদেশের বিশপ হচ্ছেন শ্রদ্ধেয় বিজয় এন ডি’ ক্রুজ, ওএমআই, ডিডি।
সকল বিশপগণের পক্ষে আর্চবিশপ প্যাট্রিক ডি’ রোজারিও সিএসসি ক্যাথলিক মন্ডলী বা চার্চ পরিচালনা করে থাকেন। বাংলাদেশে মূলতঃ তিনিই খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মগুরু। ৭টি ধর্ম প্রদেশের ৯ জন বিশপকে নিয়ে ‘বাংলাদেশের ক্যাথলিক বিশপ সম্মিলনী’ বা সিবিসিবি গঠিত। ক্যাথলিক মন্ডলী পরিচালনার ক্ষেত্রে এই বিশপ সম্মিলনীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের সকল বিশপগণই বাঙ্গালী কিংবা বাংলাদেশী। আর্চ বিশপ মহোদয় ঢাকার ১ নং কাকরাইলে অবস্থিত আর্চ বিশপস্ হাউজে বসবাস করেন।
প্রটেস্ট্যান্ট মন্ডলী : ক্যাথলিক মন্ডলী ছাড়াও বাংলাদেশে প্রটেস্ট্যান্ট মন্ডলী রয়েছে। ষোড়শ শতাব্দীতে ক্যাথলিক মন্ডলীর প্রথা, নিয়মকানুন, বিধি-বিধান এবং রীতি-নীতির প্রতি দ্বিমত পোষণ এবং তার সংস্কার আন্দোলনের মধ্যদিয়েই প্রটেস্ট্যান্ট মন্ডলীর আবির্ভাব। জার্মানীর ক্যাথলিক পুরোহিত মার্টিন লুথার প্রটেস্ট্যান্ট মন্ডলীর একজন অন্যতম প্রবক্তা। ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি পুণ্যপিতা পোপ মহোদয়কে ৯৫ দফা সম্বলিত একখানা পত্র লিখেছিলেন। যেখানে তিনি তাঁর মতে ক্যাথলিক মন্ডলীর বিভিন্ন ত্রুুটিবিচ্যুতি তুলে ধরেন এবং মন্ডলীর স্বার্থে তা সংশোধনের আহ্বান জানান, যা পোপ মহোদয় গ্রহণ করেননি। মূলত এ প্রেক্ষাপটেই পুণ্য পিতা পোপ মহোদয়ের পরিচালনাধীন একক মন্ডলীতে বিভাজনের সৃষ্টি হয় এবং গড়ে উঠে প্রটেস্ট্যান্ট মন্ডলী।
প্রটেস্ট্যান্টদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মন্ডলী রয়েছে। বাংলাদেশে প্রটেস্ট্যান্ট মন্ডলীগুলোর মধ্যে প্রধান প্রধান মন্ডলীগুলো হল- চার্চ অব বাংলাদেশ, ব্যাপ্টিষ্ট চার্চ, ব্যাপ্টিষ্ট ফেলোশিপ চার্চ, গারো ব্যাপ্টিষ্ট চার্চ, সেভেন্থ ডে এডভ্যান্টিষ্ট চার্চ, এ্যাসেম্বলীস্ অব গড চার্চ (এজি চার্চ), প্রেসবেটেরিয়ান ফেলোশিপ চার্চ, লুথারিয়ান চার্চ, প্যান্টিকষ্ট চার্চ, গসপেল চার্চ, মেথডিষ্ট চার্চ, নাজরীন চার্চ, তালিতাকুমী চার্চ, ফ্রি খ্রিস্টিয়ান চার্চ অব বাংলাদেশ, চার্চ অব ক্রাইষ্ট, রিডিম্ড চার্চ অব বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য। চার্চ অব বাংলাদেশের বর্তমান প্রধান হলেন শ্রদ্ধেয় বিশপ পল শিশির সরকার। তিনি ১৫৪/১, বড়বাগ, মিরপুর-২, ঢাকা-১২১৬ এই ঠিকানায় বসবাস করছেন।
ব্যাপ্টিষ্ট চার্চ সমূহের কেন্দ্রীয় সংগঠনের নাম-বাংলাদেশ ব্যাপ্টিষ্ট চার্চ সংঘ (বিবিসিএস) যার ঠিকানা-৩৩, সেনপাড়া পর্বতা, মিরপুর-১০, ঢাকা-১২১৬ এবং ব্যাপ্টিষ্ট ফেলোশিপ চার্চের কেন্দ্রীয় সংগঠনের নাম-বাংলাদেশ ব্যাপ্টিষ্ট চার্চ ফেলোশিপ (বিবিসিএফ) যার ঠিকানা-৭ গ্রীনস্কয়ার, গ্রীনরোড, ঢাকা-১২১৫। গারো সম্প্রদায়ের ব্যাপ্টিষ্ট চার্চসমূহের কেন্দ্রীয় সংগঠন হল-গারো ব্যাপ্টিষ্ট কনভেনশন (জিবিসি) যার ঠিকানা-বিরিশিরি মিশন, পোঃ বিরিশিরি, থানা- সুসংদূর্গাপুর, জেলা-নেত্রকোনা। এছাড়াও বিভিন্ন চার্চের সমন্বয়ে রয়েছে ন্যাশনাল কাউসিল অব চার্চেস ইন বাংলাদেশ (এনসিসিবি) যা বিশ্ব চার্চ পরিষদের সাথে সম্পৃক্ত, ঠিকানা- ৩৯৫ নিউ ইস্কাটন রোড, ঢাকা-১০০০ এবং ন্যাশনাল খ্রিস্টান ফেলোশিপ ইন বাংলাদেশ (এনসিএফবি) যার ঠিকানা-মল্লিকা হাউজিং সোসাইটি, মিল্কভিটা রোড, মিরপুর-৬, ঢাকা-১২১৬। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় এ সমস্ত চার্চের সদস্যগণ বসবাস করেন।
খ্রিস্টান ধর্মের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ও অনুষ্ঠানাদি
বড়দিন : বড়দিন বা ক্রিস্মাস খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। ২৫শে ডিসেম্বর এ দিনটি বাংলাদেশসহ সরাবিশ্বে যথাযোগ্য মর্যাদা এবং আনন্দ উৎসবের মধ্য দিয়ে খ্রিস্টানগণ পালন করে থাকেন। এ দিন মানব জাতির মুক্তিদাতা প্রভু যীশু খ্রিস্ট জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। এখন থেকে দু’হাজার ১২ বৎসর আগে কনকনে শীতের রাতে যিরূশালেমের বেথলেহেম নগরীর এক জরাজীর্ণ গোশালায় তিনি জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। তাই এ দিনটি খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যমন্ডিত।
পূণ্য শুক্রবার : পুণ্য শুক্রবার খ্রিস্টান ধর্মালম্বীদের শোকের দিন, বেদনার দিন। এ দিনে বিপদগামী ইহুদীরা নিরপরাধ যীশু খ্রিস্টকে বর্তমান যিরূশালেমের ক্যালভেরী পর্বতে ক্রুশবিদ্ধ করে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। পাপ থেকে মানব জাতির মুক্তির জন্যই তিনি ক্রুশে প্রাণ দিয়েছিলেন এ দিনে।
ইস্টার সানডে : ইস্টার সানডে বা পুনরুত্থান রবিবার খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব। পুণ্য শুক্রবারে বিপদগামী ইহুদীরা যীশু খ্রিস্টকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করে এবং পাশেই এক পর্বতের গুহায় সমাহিত করে। মৃত্যুর তৃতীয় দিবস রবিবার দিন তিনি মৃত্যু থেকে বেঁচে উঠেন বা পুনরুত্থান করেন। তাই এ দিনটিকে পুনরুত্থান রবিবার বলা হয়। দিনটি খ্রিস্ট বিশ্বাসীদের জন্যে তাৎপর্যপূর্ণ এবং অত্যন্ত আনন্দের।
মৃত্যুলোকের পর্ব দিবস : প্রতি বৎসর ২ নভেম্বর মৃত্যুলোকের পর্ব দিবস বা ‘অষষ ঝড়ঁষং উধু’ পালন করা হয়। এ দিন চার্চে এবং কোথাও কোথাও কবরস্থানে বিশেষ প্রার্থনানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। মৃত আত্মীয় স্বজন এবং সকলের আত্মার মঙ্গল কামনা করা হয় এ বিশেষ প্রার্থনানুষ্ঠানে। এ দিন ফুলে ফুলে ও প্রজ্জলিত মোমেরবাতিতে ভরে উঠে সকল সমাধিস্থল।
খ্রিস্টান জনসংখ্যা
বর্তমানে বাংলাদেশে খ্রিস্টান জনসংখ্যা ৫ লক্ষাধিক হবে। ১৬৮২ খ্রিস্টাব্দে আমাদের এ ভূখন্ডে ক্যাথলিক খ্রিস্টভক্তের সংখ্যা ছিলো ১৪১২০ জন, যা বর্তমানে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে আনুমানিক সাড়ে ৩ লক্ষ জন। ক্যাথলিক চার্চ বা ধর্মপল্লী ৯৪ টি, উপ-ধর্মপল্লী ৪৩ টি, বিশপ ৯ জন, পুরোহিত ৩৫৬ জন, ব্রাদার ১০১ জন, সিস্টার ১০৬১ জন রয়েছে বলে জানা যায়। প্রটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টভক্তের সংখ্যা আনুমানিক ১ লক্ষ ৫০ হাজার। খ্রিস্টান জনসংখ্যার শিক্ষার হার ৯৫ শতাংশের অধিক। খ্রিস্টান জনগণের প্রায় ৬০ শতাংশ বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি ভুক্ত।
বাংলাদেশে খ্রিস্টান সমাজের অবদান
শিল্প ও সাহিত্যে : বাংলা সাহিত্যে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের অবদান গরুত্বপূর্ণ। পর্তুগীজ ফাদার মানুয়েল দ্যা এসামপস্ কৃপা শাস্ত্রের অর্থবেদ রচনা করেন, যা ১৭৪৩ খ্রিস্টাব্দে লিস্বনে রোমান হরফে মুদ্রিত হয়। তিনি ৪০ পাতার বাংলা ব্যাকরণ বই; ৫২৯ পাতার বাংলা-পর্তুগীজ,পর্তুগীজ-বাংলা অভিধান রচনা করেছিলেন। ব্যাপ্টিষ্ট মিশনারী, উইলিয়াম কেরী ইংরেজী বাইবেলের বাংলা অনুবাদ, বিভিন্ন প্রকার বই এবং অভিধান রচনা করেছিলেন বাংলায়। তিনি বাংলা মুদ্রণ হরফ তৈরী করে সংবাদপত্র ও বিভিন্ন সাময়িকী প্রকাশ করেন। বর্তমান সময়ে ফাদার মারিনো রিগন এবং সিলভানো গ্যারিলো বিভিন্ন প্রকার বই-এর অনুবাদ করে বাংলা সাহিত্যের বিকাশে ভূমিকা রাখছেন। এছাড়াও বিভিন্ন খ্রিস্টান লেখক বাংলা সাহিত্যের বিকাশে কাজ করে যাচ্ছেন। স্বাধীনতা পদক প্রাপ্ত প্রখ্যাত সুরকার ও সংগীত পরিচালক প্রয়াত সমর দাস, একুশে পদক প্রাপ্ত প্রয়াত ওস্তাদ পি.সি. গমেজ, বর্তমান সময়ে কন্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোর, যোসেফ কমল রড্রিক্স, অনিমা মুক্তি গমেজ, অনিমা ডি’ কস্তা, আইরিন সাহা, গীটার শিল্পী কিশোর ছেড়াও, গীতিকার লিটন অধিকারী রিন্টুসহ আরও অনেকে অবদান রেখেছেন এবং এখনও রেখে চলেছেন। জাতীয় পর্যায়ে অভিনয়ে পিটার গমেজ (জাম্বু), জন মার্টিন ডি’ রোজারিও, টনি ডায়েস-এর নাম উল্লেখযোগ্য।
স্বাধীনতা যুদ্ধে : বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে খ্রিস্টান জনগণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। কয়েকজন পুরোহিতসহ অনেক খ্রিস্টভক্ত শহীদ হয়েছেন, প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম-শহীদ ফাদার মারিও ভেরনিসি (ইতালিয়ান),শহীদ ফাদার লুকাস মারান্ডী, শহীদ ফাদার উইলিয়াম ইভান্স(আমেরিকান), শহীদ সিস্টার ইন্মানুয়েল,শহীদ পল স্বপন কুমার বিশ্বাস, শহীদ প্রকাশ বিশ্বাস, শহীদ অনিল সরদার ,শহীদ ফুলকুমারী তরফদার,শহীদ মগদেলিনা তরফদার, শহীদ পবিত্র বিশ্বাস, শহীদ অনিল মন্দা, শহীদ পরিমল দ্রং, শহীদ আরং রিছিল, শহীদ হিউর্বাট অনিল সুমন্তি, শহীদ পরেশ চন্দ্র গাইন, শহীদ টমাস আশীষ ব্যাপারী, শহীদ আন্তনী পিউরীফিকেশন, শহীদ আগষ্টিন পেরেরা, শহীদ রবি ডি কস্তা, শহীদ রেজিনাল্ড গমেজ, শহীদ অনীল কস্তা, শহীদ সুভাষ বিশ্বাস, শহীদ খোকন সলোমন পিউরীফিকেশন, শহীদ খ্রীস্টফার ডি’ সিলভা ও নাম না জানা আরো অনেকে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। যুদ্ধের সময় খ্রিস্টান অধ্যুষিত গ্রামগুলো ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের আ¤্রকাননে অস্থায়ী সরকার গঠনকালে ভবরপাড়া ক্যাথলিক চার্চের আসবাবপত্র-সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছিল। তৎকালিন ফাদার এবং পরবর্তীতে বিশপ ফ্রান্সিস গমেজ অস্থায়ী সরকার গঠনে সহায়তা করেছিলেন। প্রখ্যাত সংগীত শিল্পী, সুরকার সমর দাস স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একজন সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত ও উদীপ্ত করে স্বাধীনতা যুদ্ধে অনন্য ভূমিকা রেখেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ গড়ার কাজে খ্রিস্টান সমাজ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
সেবা ও উন্নয়নমূলক কাজে : সেবা ও উন্নয়নমূলক কাজে খ্রিস্টান সমাজের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। মিশনারীজ অব চ্যারিটিসহ বিভিন্ন চার্চের সেবাধর্মী প্রকল্পগুলো দেশের মানুষকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অবিরাম সেবা দিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়ন, পুনঃর্বাসন, কল্যাণ এবং স্বাস্থ্য সেবা খাতে কাজ করছে কারিতাস বাংলাদেশ, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ, সিসিডিবিসহ আরও অনেক বেসরকারী উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা। বেসরকারী উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান গঠন এবং মানবাধিকার আন্দোলন প্রতিষ্ঠায় ফাদার রিচার্ড উইলিয়াম টিম সিএসসি, ফাদার ইউজিন হোমরিক সিএসসি ও কারিতাস বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
শিক্ষা ক্ষেত্রে : শিক্ষা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের খ্রিস্টান সমাজের অবদান দ্রুব তাঁরার মতই। খ্রিস্টান মিশানারীদের দ্বারা পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের আপামর জনগনের ভূয়সী প্রশংসা এবং আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। ঢাকার নটরডেম কলেজ, হলিক্রশ কলেজ, সেন্ট যোসেফস্ স্কুল এন্ড কলেজ, সেন্ট গ্রেগরী হাই স্কুলসহ দেশের বিভিন্ন জেলা এবং অঞ্চলে পরিচালিত মিশনারী স্কুলগুলো অত্যন্ত মানসম্মত এবং সুপ্রতিষ্ঠিত। এছাড়াও ওয়াইডব্লিউসিএ স্কুল এন্ড কলেজসহ খ্রিস্টান প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি বিশেষ দ্বারা পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও সুনামের সাথে শিক্ষা সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য সেবা খাতে : স্বাস্থ্য সেবা খাতে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের অবদান উল্লেখযোগ্য। নার্সিং সেবায় বাংলাদেশে খ্রিস্টান মেয়েরা অগ্রপথিকের ভূমিকা পালন করে বর্তমানে এ পেশায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। হলিফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতাল খ্রিস্টানদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি হাসপাতাল; যদিও বর্তমানে তা আর খ্রিস্টানদের দ্বারা পরিচালিত নয়। চন্দ্রঘোনা, মালুমঘাট, রাজশাহী, হালুয়াঘাট, পূবাইলের করমতলাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় খ্রিস্টানদের দ্বারা পরিচালিত হাসপাতালগুলো মানসম্মত ও নির্ভেজাল সেবা প্রদান করছে দেশের আপামর জনগণকে।
সমবায় আন্দোলনে : সমবায়ের অগ্রগতিতে খ্রিস্টান সমাজের ভূমিকা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। দেশের সমবায় আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে খ্রিস্টান সমবায় সমিতিগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত দি খ্রিস্টান কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লিঃ, ঢাকা দেশের একটি বৃহৎ সমবায় সমিতি হিসেবে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করছে। এই সমিতির উদ্যোগে এবং এর শিক্ষা তহবিলের অর্থ ব্যবহার করে ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে দি কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লীগ অব বাংলাদেশ লিঃ (কাল্ব) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কাল্ব বর্তমানে বাংলাদেশে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কাজ করে যাচ্ছে। ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে দি এসোসিয়েশন অব খ্রিস্টান কো-অপারেটিভ সোসাইটিস ইন বাংলাদেশ গঠন করা হয়েছে যার মাধ্যমে আরও বেশী ভূমিকা রাখা যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বৈদেশিক রেমিটেন্স প্রবাহে : বৈদেশিক রেমিটেন্স প্রবাহেও বাংলাদেশের খ্রিস্টান সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকা থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের লোকজন দেশে প্রেরণ করছেন প্রতিবৎসর, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে।
ব্যবসা-বাণিজ্যে : ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও খ্রিস্টান সমাজের অবদান একেবারে কম নয়। প্রয়াত স্যামসন এইচ চৌধুরী, প্রয়াত যোসেফ লরেন্স মেন্ডিস্, প্রয়াত খ্রিস্টফার গমেজ, মিঃ স্টিফেন গমেজ, এনস্লেম এ. কুইয়া দীর্ঘদিন ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথে সম্পৃক্ত থেকে বাংলাদেশের ব্যবসা জগতে অবদান রেখেছেন। বর্তমান সময়েও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের লোকজন এগিয়ে যাচ্ছেন এবং ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছেন।
ক্রীড়া জগতে : ক্রীড়া জগতে জাতীয় পর্যায়ে যে সকল খ্রিস্টান খেলোয়ার বা ক্রীড়াবিদ অবদান রেখেছেন তাঁদের মধ্যে- প্রয়াত চিহ্লা মং চৌধুরী মারী, প্রয়াত লিও ছেড়াও, প্রয়াত ইউজিন গমেজ, প্রয়াত দেবীনাশ সাংমা, রেমন্ড হালদার, মিস্ ডলি ক্রুশ, মিউরেল গমেজ-এর নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।
লেখক :
নির্মল রোজারিও, সচিব, খ্রিস্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট। মোবাইল : ০১৭১৫০৩০৯৮৯
এলড্রিক বিশ্বাস, নির্বাহী সম্পাদক, মাসিক সমবার্তা। মোবাইল : ০১৫৫৬৩৬১৫৯৯
তথ্যসূত্র : বাংলাদেশ খ্রীষ্টমন্ডলী Ñ যেরোম ডি’ কস্তা, বাংলার চার্চের ইতিহাস- ডেনিস দীলিপ দত্ত, বাংলাদেশ আদমশুমারি-২০০১, ওয়ার্ল্ড খ্রিষ্টিয়ান এনসাইক্লোপেডিয়া ও দি ক্যাথলিক ডিরেক্টরি অব বাংলাদেশ-২০১১।