বগুড়ায় ১০ ডিসেম্বর থেকে মুক্তি বাহিনী ও মিত্র বাহিনী কাধে কাধ মিলিয়ে মরন কামড় দিয়েছিল, পাক-হানাদার বাহিনির বিরুদ্ধে

বগুড়া প্রতিনিধি, এম নজরুল ইসলাম, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৭ (বিডি ক্রাইম নিউজ ২৪) : ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর। এইদিন বগুড়ায় তখন বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা। ১৩ ডিসেম্বরের আগে ১০ ডিসেম্বর থেকে হানাদার বাহিনির বিরুদ্ধে, মুক্তি বাহিনী ও মিত্র বাহিনী কাধে কাধ মিলিয়ে মরন কামড় দিয়েছিল। আকাশে মিত্র বাহিনীর বোমারু বিমান, মাটিতে মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর অভিযানে দিশেহারা পাক-হানাদার বাহিনী কোনঠাসা হয়ে পড়ে। নভেম্বরের শেষদিকে বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দি থানা প্রথম হানাদার বাহিনী মুক্ত হওয়ার পর একেএকে সোনাতলা, গাবতলী, শিবগঞ্জ, ধনুট ও শেরপুর মুক্ত হয়। এরপর একসাথে ১৩ ডিসেম্বর বগুড়া সদর, কাহালু, নন্দীগ্রাম, দুপচাঁচিয়া থানায় হানাদারদের পতন ঘটে। আদমদীঘি ১২ ডিসেম্বর হানাদার মুক্ত হয়। তুমল লড়াইয়ের পর ১৩ ডিসেম্বর হানাদার মুক্ত বগুড়া শহরে বারুদের গন্ধে বাতাস ভাড়ি হয়ে ওঠে।
সেদিনের সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ১০ ডিসেম্বর ভোর থেকেই মুক্তিযোদ্ধারা বগুড়াকে শত্রুমুক্ত করার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। এজন্য তারা শহর থেকে তিন কিলোমিটার উত্তরে নওদাপাড়া, চাঁদপুর ও ঠেঙ্গামারা এলাকায় নিজেদের অবস্থান সুসংহত করেন। পরে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর ৬৪ মাউন্টেন্ট রেজিমেন্টের বিগ্রেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার প্রেম সিংহের নেতৃত্বে ট্যাংক নিয়ে তাঁরা শহরের দিকে অগ্রসর হন। ওইসব এলাকার অসংখ্য যুবকও সেদিন তাঁদের সঙ্গে পাকিস্থানী বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মুক্তিযোদ্ধারা জানান, বগুড়া শহরে সকাল থেকে হানাদার বাহিনীর ওপর মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনী তীব্র আক্রমন শুরু করে। মাগরিবের নামাজের পর ফটকি ব্রীজের কাছে মিত্র বাহিনী তাদেরকে পাক-হানাদার বাহিনীর নিহতদের লাশ ও আহতদের পৃথক করতে বলে। এরপর মিত্র বাহিনী তাদের স্থান ত্যাগ করতে বলেন। পাক বাহিনী মুক্তি বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে নারাজ। তাদের কাছে মুক্তি বাহিনী আন্তর্জাতিক বাহিনী নয় ‘জেনাভা কনভেন্সন’ অনুযায়ী নিয়মিত বাহিনীর কাছে তারা আত্মসমর্পণ করতে চায়। এছাড়া তাদের ভয় ছিল মুক্তি বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলে, তারা তাদের মেরে ফেলতে পাড়ে। তারা সেখান থেকে পাক বাহিনীর ১৩৭ জনকে আহত এবং ৩৭ জনের মৃত দেহ পেয়েছেন। ১৩ ডিসেম্বর বিকালে ঘোষনা দেওয়া হয় বগুড়া শহর হানাদার মুক্ত। ১৪ ডিসেম্বর সকালে তারা জনশূন্য শহর দেখতে পান।
বগুড়া জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক সাংগঠনিক বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মোত্তালিব মানিক জানান, ১৩ ডিসেম্বর বগুড়ার কয়েকটি জায়গায় পাক-হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। সারিয়াকান্দি ও গাবতলী থেকে ১১ জন হানাদারকে আটক ও এদের মধ্যে ৫ জন মারা পড়ে। ৬ জনেক মিত্র বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মোত্তালিব মানিক বলেন, ১৩ ডিসেম্বর পাক-হানাদার বাহিনী বগুড়া পৌরপার্কে মুক্তিযোদ্ধার আরেকটি দল পাক সেনাদের সাথে যুদ্ধের জন্য শিবগঞ্জ থেকে বগুড়া শহরে ঢুকেছিল। হিলি সীমান্ত থেকে বগুড়ায় ঢোকার পর মহাস্থানে মিত্র বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা’ পাক-হানাদার বাহিনীর শক্ত প্রতিরোধের মুখে পড়েছিল। মহাস্থানের টিলায় পাক হানাদার বাহিনী অবস্থান নিয়ে গুলি চালালে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনীর বেশ কয়েকজন সেনা হতাহত হয় এবং পাল্টা প্রতিরোধে হানাদার পাক-বাহিনীর সৈন্য নিহত হয়।
তিনি জানান, ১৯৭১ সালে ১০ ডিসেম্বর ভোরে মিত্র বাহিনী (ভারতীয় সেনা) ’র ৬৪ মাউন্টেন রেজিমেন্টি ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার প্রেম সিংহ এক ব্রিগেড সেনা নিয়ে বগুড়া শহরের ৩ কিলোমিটার উত্তরে নওদাপাড়া-চাঁদপুর ও ঠেঙ্গামারা গ্রামের মধ্যবর্তী স্থান লাঠিগাড়ি মাঠ সংলগ্ন বগুড়া রংপুর শহরে অবস্থান নেয়। আর্টিলারি ডিভিশন সেখানে বাঙ্কার খনন করে অবস্থান নেয়। তারা বগুড়া শহরে পাক সৈন্যদের অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে শহরে অভিযান পরিচালনার জন্য ফ্রন্ট ফাইটার গোর্খা বাহিনীর সৈন্যরা ট্যাংক নিয়ে শহর অভিমুখে মার্চ করে। ১০, ১১ ও ১২ ডিসেম্বর তুমল যুদ্ধ হয়। ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যার দিকে পাক-হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করবে বলে সংবাদ পাওয়া গেলে, বগুড়াবাসী সহ মিত্র বাহিনীর শিবিরে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। ১৩ ডিসেম্বর রাতের পর থেকে বুক ভরা শ্বাস ফেলে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামি মানুষ।
জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক সাংগঠনিক বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মোত্তালিব মানিক আরও জানান, মুক্তি বাহিনী ও মিত্র বাহিনীর মরন কামড়ে দিশেহারা হয়ে পাক-হানাদার বাহিনীর দোষর রাজাকার, আলবদর, আলসাম্স ও মুসলিম লিগের পান্ডারা ও বগুড়ার বিভিন্ন গ্রামে ও বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপন করে। ১৬ ডিসেম্বরের পর টানা দুই বছর আত্মগোপনে থাকার পর ধীরেধীরে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। এছাড়া ’৭১ সালের নভেম্বর মাসে শহরের বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করে বাবুরপুকুর নামকস্থানে ধরে নিয়ে গিয়ে ১৪ জনকে গুলি করে হত্যা করেছিল হানাদার বাহিনী। সেইসব শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সেখানে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিসৌধ। ফুলবাড়ীতে পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ের স্মরণে ২০০৫ সালে ‘মুক্তির ফুলবাড়ী’ নামে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম সম্বলিত স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। বগুড়া শহরের প্রাণকেন্দ্র সাতমাথায় দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নির্মিত হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ স্কোয়ার। প্রাচীন সভ্যতার ঐতিহাসিক নগরী মহাস্থানগড় খ্যাত বগুড়া মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেও অনেকটা স্থান জুড়ে রয়েছে। আগামী প্রজন্মকে সেই ইতিহাস সঠিকভাবে জানাতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *