কারা সুশীল সমাজ,

সমাজ
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম
‘সুশীল সমাজ’ (‘Civil Society’) নিয়ে আজকাল এদেশের শিক্ষিত মানুষের মুখে মুখে হরদম নানা আলোচনা শোনা যায়। শুধু একাডেমিক ও তাত্ত্বিক আলোচনার ক্ষেত্রেই নয়, দেশের চলতি রাজনীতি সম্পর্কে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ-পরামর্শের ক্ষেত্রেও আজকাল হরহামেশাই ‘সুশীল সমাজের’ প্রসঙ্গটি বিশেষ গুরুত্বের সাথে কতিপয় মহল থেকে কথায় কথায় উচ্চারিত হয়ে থাকে।  তিন-চার দশক আগে কিন্তু ঠিক এরকমটি ছিলো না।
‘সুশীল সমাজের’ প্রসঙ্গটিকে কয়েকদিন আগে আবার সামনে আনলেন এদেশে নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার। তিনি বলেছেন যে, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সমস্যা দূর করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলাপ-আলোচনার হওয়া যেমন উচিত, তেমনি তাদের উচিত সে বিষয় নিয়ে দেশের ‘সুশীল সমাজের’ সাথেও আলোচনা করা। পশ্চিম কূটনৈতিক মহল থেকে এর আগেও ‘সুশীল সমাজ’ নিয়ে অস্বাভাবিক মাত্রায় আগ্রহ ও গুরুত্ব প্রদানের ঘটনা লক্ষ্য করা গেছে। কোন দূরভিসন্ধি নিয়ে তা করা হয়েছিলো, সেটি টের পেতে দেশবাসীর বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। অথচ ‘সুশীল সমাজ’ বিষয়টি নিয়ে এতো হৈ-চৈ হওয়া সত্ত্বেও, তা আসলে কী, তা নিয়ে সর্বত্র একটি রহস্যপূর্ণ ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। তাই এখন দেখা যাক, ‘সিভিল সোসাইটি’ বা ‘সুশীল সমাজ’ সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন কতো রকম ধারণা বিদ্যমান রয়েছে।
বাংলাদেশে ‘সুশীল সমাজ’ অভিধাটির বহুল ব্যবহার ও প্রয়োগ শুরু হয়েছে তিন দশক আগে, ’৮০-র দশকের প্রথমার্ধ্ব থেকে। আজকাল পত্রিকার কলামে, টিভির টক-শোতে, সংবাদ প্রতিবেদনে, সেমিনারে, গোলটেবিল আলোচনায়, মানববন্ধনের ঘোষণায়, পাঁচতারা হোটেলের আলোচনা সভায়, বিশিষ্টজনদের বক্তৃতায়-ভাষণে, পোস্টার-ব্যানার-হোর্ডিংয়ে,— প্রায় সর্বত্রই বহুল উচ্চারিত ও ব্যবহূত একটি প্রসঙ্গ হলো ‘সুশীল সমাজ’। বিশ্বপরিমণ্ডলেও সেই ’৮০-র দশক থেকেই ‘সুশীল সমাজ’ প্রসঙ্গটিকে ‘জাতে উঠতে’ দেখা গেছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দলিলে ও প্রতিবেদনে, দাতা সংস্থাগুলোর নির্দেশাবলি ও সুপারিশে, গ্লোবাল সংস্থাগুলোর বিশ্লেষণ ও প্রতিবেদনে, নামী-দামী হিসাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া বিশ্বের পণ্ডিত মহলের গবেষণাপত্র ও থিসিসে ‘সুশীল সমাজে’র  প্রসঙ্গটিকে পরিণত করা হয়েছে আলোচনার একটি কেন্দ্রীয় বিষয়ে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, ‘সিভিল সোসাইটি’ বা ‘সুশীল সমাজ’ বিষয়টি যে আসলে কী, তা আগে মীমাংসা না করেই সেটি নিয়ে এতো কথাবার্তা হচ্ছে।
দেশের যেসব বিজ্ঞজন উঠতে-বসতে হরহামেশা ‘সুশীল সমাজ’ অভিধাটি ব্যবহার করে থাকেন তাদেরকে যদি আলাদা-আলাদা করে জিজ্ঞেস করা হয় যে ‘সুশীল সমাজ’ কাকে বলে, তাহলে সকলে একরকম জবাব দেবেন না। একেকজনের জবাব হবে একেকরকম। আবার একই বিজ্ঞজন একেকবার একেকরকম জবাব দেবেন। এর একটি প্রধান কারণ হলো, ‘সুশীল সমাজ’-এর সংজ্ঞায়ন করতে গেলে তাদেরকে হয় সর্বসাধারণের কণ্ঠস্বর ও মুখপাত্র হওয়ার স্বঘোষিত দাবি পরিত্যাগ করতে হয়, নয়তো মুষ্টিমেয় বিজ্ঞবান সামাজিক অভিজাত স্তরের ব্যক্তির দ্বারা দেশের জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন নির্ধারিত ও প্রতিস্থাপিত বলে একটি গণতন্ত্র-পরিপন্থি তত্ত্ব হাজির করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ‘সুশীল সমাজে’র সংজ্ঞায়নে তাদের সচেতন অনীহার পেছনে রহস্যের একটি প্রধান কারণ সম্ভবত এটি।
অতি সরল ও সাদামাটাভাবে ব্যাখ্যা দিয়ে তারা বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, ‘সুশীল সমাজ’ হলো দেশের সামরিক পরিমণ্ডলের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত একটি সামাজিক সত্তা। ‘মিলিটারি’র বাইরে যেমন ‘সিভিল’, তেমনই ‘সামরিকে’র বাইরের সত্তা হলো ‘বেসামরিক’। সেই বেসামরিকের উন্নত শব্দগত রূপান্তর হলো ‘সুশীল’। অতি সহজ সরল কথা! তাই সংজ্ঞায়ন নিয়ে এতো কথা জিজ্ঞাসার কী আছে?  কিন্তু কথা এতো সহজ নয়! ‘সুশীল সমাজ’ হলো সমাজের ‘বেসামরিক’ অংশ, এ ধরনের ব্যাখ্যা মেনে নিলে বলতে হয় যে মন্ত্রী, এমপি, বেসরকারি প্রশাসনের লোকজন, রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী-সদস্যবৃন্দ, ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীসহ দেশের সব বেসামরিক নাগরিকের সমন্বয়েই একটি দেশের ‘সুশীল সমাজ’ গঠিত। অর্থাত্ সামরিক বাহিনীর দু’এক লাখ সদস্য ব্যতীত দেশের সব নাগরিকই ‘সুশীল সমাজে’র সদস্য। এভাবেই যদি তাকে সংজ্ঞায়ন করা হয়, তাহলে ‘সুশীল সমাজে’র আলাদা কৌলিন্য ও বিশেষ গুরুত্ব থাকে কোথায়?
এমতাবস্থায় ‘সুশীল সমাজে’র সংজ্ঞা নির্ধারণে ‘অশীল’ শব্দের বিপরীতে ‘সুশীল’ শব্দের অর্থগত ধারণার কথা বলা হয়ে থাকে। এর দ্বারা শুধুমাত্র শিক্ষিত, মার্জিত, কৌলিন্যসম্পন্ন, ভদ্রশ্রেণির মানুষ নিয়ে ‘সুশীল সমাজ’ গঠিত বলে সংজ্ঞায়নের চেষ্টা করা হয়। একসময়ের কলকাতার ‘বাবু সমাজ’ বলে যেভাবে সমাজের একাংশকে চিহ্নিত করা হতো, অনেকটা তেমনই! কিন্তু এতেও সমস্যা কম নয়! কারণ, সেভাবে সংজ্ঞায়িত হলে ‘সুশীল সমাজওয়ালাদেরকে’ সমস্ত সমাজের স্বঘোষিত মুখপাত্র ও প্রতিনিধি হিসেবে ‘গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল’ স্বরূপ দাবি করতে হয়। কে মানবে সে দাবি?
এসব নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে ‘সুশীল সমাজে’র চূড়োমণিরা নিজেদের নাম পাল্টে ‘নাগরিক সমাজ’ অথবা ‘জনসমাজ’ হিসেবে আখ্যায়িত হওয়ার চেষ্টা নানা সময় করেছেন। এখনও তারা তা করে থাকেন। এর দ্বারা ‘সুশীল’ বনাম ‘অশীল’ সম্পর্কিত আপত্তিকে কোনক্রমে উত্রানোর প্রয়াসে কিছুটা সফল হলেও, উত্থাপিত অন্যান্য প্রশ্ন ও আপত্তির সদুত্তর দিতে তারা অপারগ হন। কারণ গোড়ার সমস্যাটি হলো, তাদের মধ্যে ‘সিভিল সোসাইটি’ সম্পর্কিত ধারণাতেই গুরুতর বিভ্রম বিরাজ করে।
‘সুশীল সমাজে’র মতো পবিত্র (!) একটি বিষয়কে ‘আমজনতা’ হিসেবে তরলায়নের (dilution) হাত থেকে রক্ষার জন্য ‘ভদ্রজনদের’ পেরেশানের কোন শেষ নেই। এ চেষ্টায় অনেকে বলার  কোশেশ্্ করেন যে, রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল বহির্ভূত শক্তিই হলো ‘সুশীল সমাজ’। কিন্তু সেক্ষেত্রেও মুশকিল থেকে যায়। কারণ তা যদি হয় তাহলে সামরিক বাহিনীকেও ‘সুশীল সমাজে’র অন্তর্ভুক্ত বলে ধরে নিতে হয়। এই মুশকিল থেকে বের হওয়ার জন্য যদি বলা হয় যে ‘সুশীল সমাজ’ গঠিত হয় যে কোন সরাসরি রাষ্ট্রীয় এবং সরকারি সংশ্রব থেকে মুক্ত মানুষকে নিয়ে, তাহলে ধরে নিতে হয় যে, সরকার বহির্ভূত রাজনৈতিক শক্তিগুলোও ‘সুশীল সমাজে’র অংশ। আবার যদি বলা হয় যে, সরকার, সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন, রাজনৈতিক দল প্রভৃতির বাইরের উপাদান ও শক্তির সমন্বয়ে ‘সুশীল সমাজ’ গঠিত, তাহলে জট যে আরও বেড়ে যায় তাতেও কোন সন্দেহ থাকে না। সমস্যা নিঃসন্দেহে গুরুতর!
এসব জটিলতা আরও বেশি বৃদ্ধি পায় যখন এ প্রশ্ন বিবেচনায় আনা হয় যে, এনজিও (NGO)-এর ভুবন ‘সুশীল সমাজে’র অংশ কিনা। এনজিও অর্থাত্ নন-গভর্নমেন্ট অর্গানাইজেশন বা বেসরকারি সংস্থার সংজ্ঞায় তো এক অর্থে বস্তুত সব সরকার বহির্ভূত সংস্থা ও শক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ থাকে। এভাবে সব এনজিওকে সুশীল সমাজের অংশ বলে বিবেচনা করলে তার সদস্য কোটি-কোটিতে দাঁড়াবে। এরকম হলে সমস্যার যে অন্ত থাকে না, সেটা তো আগেই দেখা গেলো। এখন যদি বলা হয় যে, কিছু কিছু এনজিও ‘সুশীল সমাজে’র অন্তর্ভুক্ত এবং কিছু কিছু এনজিও তা নয়, তাহলে সংজ্ঞায়নে নতুন আরও এমন কতগুলো জটিল মাত্রা যুক্ত হয়ে পড়বে যার উত্তর পাওয়া খুবই দুঃসাধ্য। অনেকে বলবেন, এসব জটিলতা থেকে বের হওয়ার পথ হলো প্রাতিষ্ঠানিক এনজিওগুলোকে ‘সুশীল সমাজে’র আওতার বাইরে বিবেচনা করা। তাহলে তো সর্বনাশ! ‘সুশীল সমাজে’র লোক বলে নিজেদেরকে যারা জাহির করে বেড়ান, তাদের বেশির ভাগই তো হলো কোন না কোনভাবে এনজিওর সাথে সম্পর্কিত! এমন সংজ্ঞা মেনে নিলে তো ‘সুশীল সমাজে’র মাথায়ই আকাশ ভেঙ্গে পড়বে!
এতোসব সমস্যার মুখে পড়ে সম্প্রতি ‘সুশীল সমাজে’র একটি অফিসিয়াল চূড়ান্ত সংজ্ঞা দেয়ার চেষ্টা নেয়া  হয়েছে। সেই সংজ্ঞায় বলা হয়েছে যে, “সমাজের সেই অংশই হলো ‘সুশীল সমাজ’ যা কিনা রাষ্ট্র (রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান) বহির্ভূত, দল বহির্ভূত ও বাজার ব্যবস্থা বহির্ভূত”। ‘রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বহির্ভূত’ ব্যাপারটি না হয় আগেই দেখা গেলো! এক্ষেত্রে আগেই দেখা গেছে যে তাতে ‘কৌলিন্য খর্ব হওয়ার সমস্যা সৃষ্টি হয়’। ‘দল বহির্ভূত হিসেবে সংজ্ঞায়িত করার ক্ষেত্রে প্রথম কথা হলো, দেশের সব ভোটারই নির্বাচনের সময় কোন না কোন দলকে ভোট দেয়। সেই হিসেবে সব ভোটারেরই তো দলীয় সংশ্লিষ্টতা আছে। সেক্ষেত্রে উল্লিখিত সংজ্ঞা মেনে ‘সুশীল সমাজে’র অন্তর্ভুক্ত থাকতে হলে, হয় ভোট বর্জন করতে হবে, নয়তো নির্দলীয় প্রার্থীকে ভোট দিতে হবে। আর যদি বলা হয় যে, ভোট প্রদান দ্বারা দলে অন্তর্ভুক্ত হওয়া বোঝায় না, তা হলে তো দলীয় সদস্যদের বাইরে কামার, কুমার, জেলে, তাঁতি, মজুর, কিষাণ, রিকশাওয়ালা—সবাই ‘সুশীল সমাজে’র অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন হয়ে পড়ে। এটি তো আবার ‘সুশীল সমাজওয়ালারা’ মানতে রাজি নন। কারণ, মানলে তাদের ‘কৌলিন্য’ থাকে কোথায়? তাছাড়া দলীয় সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি আজকাল এতোই সূক্ষ্ম একটি বিষয় হয়ে উঠেছে যে, দেশে এখন ‘নির্ভেজাল’ নিরপেক্ষ ব্যক্তি পাওয়া দুষ্কর। আজকাল প্রায় সবাই ‘আওয়ামীপন্থি’ নিরপেক্ষ, ‘বিএনপিপন্থি’ নিরপেক্ষ ইত্যাদি ভাগে স্পষ্টতই চিহ্নিত হয়ে গেছেন। অন্যদিকে, বাজার-ব্যবস্থা বহির্ভূত অংশ বলতে কাকে বোঝায়, তা নিয়েও সমস্যা প্রকট। পণ্য-বাজারের ক্রেতা ও বিক্রেতা, শ্রম-বাজারের ক্রেতা ও বিক্রেতা ইত্যাদি সবাই তো বাজার ব্যবস্থার অংশ। তাই উল্লিখিত সংজ্ঞা মেনে নিলে দেখা যাবে যে তারা কেউই অর্থাত্ দেশের প্রায় কোন নাগরিকই, ‘সুশীল সমাজে’র অংশ হওয়ার যোগ্য নয়। সেক্ষেত্রে যদি বলা হয় যে, শুধু বাজার-ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রকদেরকেই ‘সুশীল সমাজে’র সংজ্ঞা থেকে বাদ রাখার কথা বলা হয়েছে, তাহলে দেখা যাবে যে দেশবাসীর সিংহভাগই ও ‘সুশীল সমাজে’র অংশ বলে গণ্য হওয়ার যোগ্য হয়ে যান। তাতে ‘সুশীল সমাজ’ সার্বজনীন হয়ে ওঠার সমস্যাটিও থেকেই যায়। কিন্তু ‘সুশীল সমাজের‘ ভাগ্যবান ও সমাদৃত ‘কুলীনরা’ তা মানবে কেন?
এই আলোচনাকে অনেকেই নিছকই একটি ভাষার অর্থঘটিত বিষয়ে (semantic) বিতর্ক বলে গুরুত্বহীন হিসেবে অবজ্ঞা করতে পারেন। কিন্তু এটি কেবল শব্দার্থঘটিত একটি বিতর্ক নয়। এর মর্মে রয়েছে ধারণাগত মৌলিক উপলব্ধির বিষয়। যাই হোক, এবার ‘সুশীল সমাজে’র সংজ্ঞায়নের দুঃসাধ্য প্রচেষ্টা থেকে সরে গিয়ে বাস্তবের দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক। বর্তমানে বাংলাদেশে বাস্তবে যাঁদের দ্বারা ‘সুশীল সমাজ’ গঠিত বলে ধরে নেয়া হয়, তাঁদের একটি বড় অংশ হলো সে সব সম্মানিত ব্যক্তি যাঁরা তাঁদের জীবনের একটি দীর্ঘ সময়কাল রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ডে, সরকারের সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনে, সরকারি কাজকর্মে, সরকারের উপদেষ্টারূপে অথবা পরামর্শদাতা রূপে, রাষ্ট্র পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ আসনে ইত্যাদি নানাবিধ কাজে যুক্ত থেকেছেন। এ ধরনের নানা কাজে যুক্ত অগণিত ব্যক্তিদের মধ্যকার একটি অংশের ব্যক্তিরা তাহলে হঠাত্ করে ‘সুশীল সমাজের’ সদস্যরূপে রূপান্তরিত হয়ে উঠলেন কীভাবে? দু’দিন আগে যিনি ছিলেন সচিব, উপদেষ্টা, জেনারেল, আইজিপি, ‘কমরেড’ ইত্যাদি — তারাই এখন ‘সুশীল সমাজ’! ব্যাপার কী? এমত প্রশ্নের মুখে পড়ে তাদের অনেকেই হয়তো সাফাই গেয়ে যুক্তি দেবেন যে, এ ধরনের বিজ্ঞবান ব্যক্তিরা তো তাদের এক সময়ের ‘সুশীল সমাজ’ বহির্ভূত দায়িত্ব থেকে অবসর নেয়ার পরই কেবল ‘সুশীল সমাজে’র সদস্য হয়েছেন। তাই এক্ষেত্রে তা নিয়ে কোন আপত্তি থাকতে পারে না। কিন্তু তখন আবার প্রশ্ন দাঁড়ায়, যারা একসময় হোমরা-চোমরা হিসেবে সরকার, রাজনীতি, প্রশাসন প্রভৃতি কাজে নিয়োজিত ছিলেন, তারা অবসর নেয়া মাত্র কোন্্ মায়ার কাঠির স্পর্শে, ‘সুশীল সমাজ’ বহির্ভূত অবস্থান থেকে রাতারাতি ‘সুশীল সমাজে’র সদস্য হয়ে উঠতে পারলেন?
এসব প্রশ্নের সদুত্তর না দিয়েই সমাজের উপরতলার একটি অভিজাত অংশের লব্ধ প্রতিষ্ঠিত কিছু ব্যক্তি আজ স্বঘোষিতভাবে বহাল-তবিয়তে ‘সুশীল সমাজে’র সদস্য বনে বসে আছেন। এদিকে ‘সুশীল সমাজের‘ বিষয়টিকে নিয়ে খেলা করে চলেছে ও তাদের দুরভিসন্ধি পূরণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে— পশ্চিমা দুনিয়া সাম্রাজ্যবাদ যে নয়া উদারবাদী পথ বিশ্বব্যাপী চাপিয়ে দিয়েছে তার একটি বৈশিষ্ট্য হলো, সামাজিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে রাষ্ট্রের হাত যথাসম্ভব গুটিয়ে নেয়া। সেই হিসেবে রাষ্ট্র ও সরকারের ভূমিকাকে ছোট করে আনা। সেমতাবস্থায় সমাজের বিদ্যমান কাঠামো ও গাঁথুনিকে টিকিয়ে রাখার জন্য রাষ্ট্রের নিপীড়নমূলক ভূমিকা বাড়িয়ে দেয়া। একই সাথে সমাজের প্রচলিত অর্থনৈতিক কাঠামোকে অবলম্বন করে গড়ে ওঠা ‘প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতি’ বহির্ভূত সমাজের এক শ্রেণির প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ভূমিকাকে সামনে নিয়ে আসা। এভাবে বিরাজনীতিকীকরণের ধারাকে প্রমোট করা। এটিই হলো ‘সিভিল সোসাইটি’ বা ‘সুশীল সমাজকে’ অগ্রাধিকারমূলকভাবে প্রমোট করার মাজেজা। তবে একথাও ঠিক যে, সকলেই দুরভিসন্ধি থেকে ‘সুশীল সমাজে’র সদস্যের তকমা গ্রহণ করেননি। তাদের মধ্যে অনেকেই অতি সত্ ও মহান উদ্দেশ্যে ও অতি সরল মনে নিজেদেরকে ‘সুশীল সমাজের’ সদস্য হিসেবে গণ্য করে নানা তত্পরতায় লিপ্ত রয়েছেন। দেশপ্রেমিক এবং এমনকি এক ধরনের প্রগতিশীল কাজ করছেন মনে করেন, অন্যদের সাথে তারা নিজেদেরকে এই ‘সুশীল সমাজ’-এ অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তাদের নানা উদ্যোগ ও কর্মকাণ্ড সমাজের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক অবদানও রেখে চলেছে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে গোটা ব্যাপারটি একটি অতি ‘জটিল-সুশীল’ সমাচার। নামে ‘সুশীল’ হলেও, ব্যাপারটি ‘জটিল’ কম নয় !

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *