পিলখানা ট্র্যাজেডি মামলা : ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হাইকোর্টের
ঢাকা, ০৮ জানুয়ারি ২০২০ (বিডি ক্রাইম নিউজ ২৪) : সবচেয়ে বড় মামলা হিসেবে পরিচিত পিলখানা হত্যা মামলায় হাইকোর্টের ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে। বিচারপতি মো. শওকত হোসেন, বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বৃহত্তর বেঞ্চ ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ নভেম্বর এই রায় ঘোষণা করেন। আজ বুধবার এই তিন বিচারপতির স্বাক্ষরের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়। এখন এ রায় সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটে দেয়া হবে জানিয়েছেন এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।।
২০০৯ সালে পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে সেনা সদস্য হত্যাকান্ডের মামলায় ১৩৯ জনের মৃত্যুদন্ড বহাল রেখে সংক্ষিপ্ত রায় প্রকাশ করেছিল হাইকোর্ট। বিচারপতি মো. শওকত হোসেন ১ থেকে ১১ হাজার ৪০৭ পৃষ্ঠা, মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ১১ হাজার ৪০৮ থেকে ২৭ হাজার ৯৫৯ পৃষ্ঠা ও মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ২৭ হাজার ৯৬০ থেকে ২৯ হাজার ২৯ পৃষ্ঠার এ রায় লিখেছেন। ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর এ মামলায় নিম্ন আদালতে ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত ১৫২ জনের মধ্যে ডিএডি তৌহিদসহ ১৩৯ জনের মৃত্যুদন্ড বহাল রাখেন হাইকোর্ট।
এছাড়া, বিচারিক আদালতে মৃত্যুদন্ড পাওয়া আট আসামিকে যাবজ্জীবন এবং চার জনকে খালাস দেন আদালত। একইসঙ্গে বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন পাওয়া ১৬০ জনের মধ্যে ১৪৬ জনের সাজা বহাল রাখা হয়। বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন পাওয়া আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড নেতা তোরাব আলীসহ ১২ জনকে খালাস দেন আদালত। এছাড়াও বিচারিক আদালতে তিন থেকে ১০ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদের কারাদন্ডপ্রাপ্ত ২৫৬ আসামির মধ্যে ১২৮ জনকে ১০ বছর, আটজনের সাত বছর, চারজনকে ৩ বছর এবং দুই জনকে ১৩ বছর সাজা দেয়া হয়। ২৯ জন খালাস পান। ২৮ জন আপিল করেননি। মারা গেছেন তিনজন।
হাইকোর্ট রায়ে- নিম্ন আদালতে খালাস পাওয়া ৬৯ জনের মধ্যে ৩১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেন হাইকোর্ট। চারজনকে দেন ৭ বছর কারাদন্ড। ২০১৫ সালে এ মামলায় বিচারিক আদালতে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানির জন্য হাইকোর্টে বৃহত্তর বেঞ্চ গঠন করা হয়। এই বেঞ্চে ৩৭০ কার্যদিবস আসামিদের আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বিডিআরের সদর দপ্তরে এক বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন প্রাণ হারান।
২০০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি লালবাগ থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। পরে মামলা দুটি নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তরিত হয়। বিচার হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের কাছে আলিয়া মাদ্রাসা মাঠসংলগ্ন অস্থায়ী এজলাসে। ঢাকা মহানগর তৃতীয় বিশেষ আদালতের বিচারক মো. আখতারুজ্জামান ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর ইতিহাসের বৃহত্তম এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে বিডিআরের প্রাক্তন ডিএডি তৌহিদসহ ১৫২ জনকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিএনপি দলীয় প্রাক্তন সংসদ সদস্য নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু (প্রয়াত) ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীসহ ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ২৭৭ জনকে খালাস দেয়া হয়।
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে ঢাকার পিলখানায় বিডিআর সদরদপ্তরে গুলির শব্দ শোনা যেতে থাকে। বিডিআর সপ্তাহ চলার কারণে প্রথমে অনেকেই ভাবছিলেন ভেতরে হয়ত কোনো কর্মসূচি চলছে। কিন্তু পরে জানা যায় ভেতরে বিদ্রোহ হয়েছে এবং পিলখানার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে জওয়ানরা। এরপর দেশের বিভিন্ন জেলায় বিডিআর দপ্তরেও বিদ্রোহের খবর পাওয়া যায়। একপর্যায়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনা হয়। এরপর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পিলখানায় গেলে বিদ্রোহীরা তার কাছে অস্ত্র সমর্পণ করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বেরিয়ে আসার সময় বিদ্রোহীদের হাতে জিম্মি কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবারকে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন।
একপর্যায়ে পরদিন ২৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশ ও সেনাবাহিনী পিলখানার নিয়ন্ত্রণ নেয়। অবসান ঘটে বিদ্রোহের। তবে বিদ্রোহের প্রথম দিন দুপুরে কামরাঙ্গীরচর বেড়িবাঁধের কাছে ম্যানহোলের মুখে দুই বিডিআর কর্মকর্তার লাশ পাওয়া যায়। আর বিদ্রোহ অবসানের পরদিন পিলখানায় পাওয়া যায় একাধিক গণকবর। সেখানে পাওয়া যায় বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ, তার স্ত্রীসহ সেনা কর্মকর্তাদের লাশ। রক্তাক্ত ওই বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) এর নাম বদলে এই বাহিনী নাম দেয়া হয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন ওই বিদ্রোহের ঘটনার পর ৫৭টি বিদ্রোহের মামলার বিচার হয় বাহিনীর নিজস্ব আদালতে। সেখানে ছয় হাজার জওয়ানের কারাদন্ড হয়। কিন্তু পরে পিলখানায় হত্যাকান্ডের মামলার বিচার শুরু হয় ঢাকার বিচারিক আদালতে। দীর্ঘ বিচারিক কার্যক্রম শেষে ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর রায় দেন বিচারিক আদালত। পিলখানা মামলায় হাইকোর্ট রায় বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষ রায় পর্যালোচনা করে আপিলের কথা জানিয়েছেন।