বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা রক্ষী সার্জেন্ট ইসলামের সঠিক মূল্যায়ন চায় পরিবার
চৌদ্দগ্রাম (কুমিল্লা) প্রতিনিধি, মো. আব্দুল মান্নান, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৯ (বিডি ক্রাইম নিউজ ২৪) : গত সোমবার (১৬ ডিসেম্বর) বিজয়ের ৪৮ বছর পূর্ণ হওয়ার মধ্য দিয়ে ৪৯ বছরে পদার্পণ করলো বাংলাদেশ। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে ৩০ লক্ষ বীরের প্রাণের বিনিময় এবং ২ লাখেরও বেশী মা-বোনের সম্ভ্রমহানির মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের এই দিনে অর্জিত হয় আমাদের মহান স্বাধীনতা। উদিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নীল সূর্য্য। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমান এর ধানমন্ডি ৩২ নং বাড়ীর নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য, ব্রিটিশ আর্মি ও বাংলাদেশ আর্মির সদস্য কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের মরহুম বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসলাম মিয়ার সঠিক মূল্যায়ন চায় তার পরিবার।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম ইসলাম মিয়া উপজেলার মুন্সীরহাট ইউনিয়নের দেড়কোটা গ্রামের মৃত মো. মোজাফ্ফর আলীর পুত্র। তিনি ১৯২৫ সালে ৩১ ডিসেম্বর সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। ছাত্রজীবনে মেধাবী ছাত্র হিসেবে এলাকায় তাঁর বেশ সুনাম ছিল। দেশের প্রতি মমত্ববোধ ও দায়িত্ববোধ থেকে ১৯৪২ সালে ২২ নভেম্বর ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর (এমওডিসি) কোরে ভর্তি হন তিনি। যার সেনা নং ছিল-৮৮০৫২২৫। ১৯৫৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রতিরক্ষা বাহিনী হতে ল্যান্স নায়েক পদোন্নতি পান তিনি। পরবর্তীতে তিনি হাবিলদার পদমর্যাদায় চাকুরীরত অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেন।
১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত স্থায়ী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে যুদ্ধে তাঁর অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৩৯/৪৫ পদক ও ডঅজ গঊউঅখ পদক লাভ করেন। এছাড়াও তিনি সেনাবাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় বিভিন্ন কৃতিত্বের জন্য ঝওঞঅজ-ও-ঐঅজই পদক, ঞঅগএঅ-ঊ-ঔঅঘএ পদক ও ইঅজগঅ ঝঞঅজ পদক লাভ করেন। পদক প্রাপ্তিসহ তাঁর অবদানের কথাগুলো এখনো রাজেন্দ্রপুর ক্যান্টনমেন্ট এর রেকর্ড শাখায় লিপিবদ্ধ রয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর মতাদর্শে দৃঢ় বিশ্বাসী মরহুম বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসলাম মিয়া ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষনে উজ্জীবীত হয়ে তেজোদীপ্ত মনে লড়াকু মানসিকতায় শপথ নিয়ে জাতির পিতার ডাকে সাড়া দিয়ে স্বীয় জীবন ও পরিবারের সুখের মোহ ত্যাগ করে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের উদ্দেশ্যে অনিশ্চিত যাত্রায় সামরিক বাহিনীর সাথে ২নং সেক্টরে সম্মুখ সমরে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণের পাশাপাশি এলাকার যুবকদেরকে ট্রেনিং করাতেন নিজ আগ্রহে।
পরবর্তীতে তিনি ভারতের শরনার্থী ক্যাম্পে গিয়ে নিজেও উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদেরও প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। মুক্তিযোদ্ধা যাদুঘরে সংরক্ষিত প্রামাণ্য দলিলে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট খন্ড নং (৪) এ ১২৬ নং তালিকায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা সদস্য নং -৩০৭৫৩ (ভারতীয় সনদ নং) হিসেবে যা তথ্য ও দলিল হিসেবে এখনো সংরক্ষিত রয়েছে। এছাড়াও পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক প্রতি স্বাক্ষরিত বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ড কাউন্সিল সনদ ক্রমিক নং ২১৯৪৬ (২০০০ইং), এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কর্তৃক স্বাক্ষরিত সনদের ক্রমিক নং-ম-৮৫৩৭৩ (২৮/০১/২০০৪) এ দলিল হিসেবে সংরক্ষিত রয়েছে।
যুদ্ধ পরবর্তী কালে বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের নিরাপত্তা রক্ষায় ধানমন্ডির ৩২ নং বাড়িতে নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে দায়িত্ব পালন করেন মরহুম বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসলাম মিয়া। হঠাৎ কোন এক অজানা কারণে মরহুম বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসলাম মিয়া ও তাঁর সাথীদেরকে সেনা ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া হলে তিনি মানসিকভাবে বেশ ভেঙ্গে পড়েন এবং বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা নিয়ে সঙ্কিত হয়ে পড়েন। সেসময় রুটিন ওয়ার্কের পাশাপশি নিয়মিত নামাজ আদায়ের পাশাপাশি নফল ইবাদত করে বঙ্গবন্ধুর জন্য খাস দিলে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা যেন তার নিয়মিত অভ্যাস ছিল।
এমনই সময়ের মাঝে হঠাৎ করে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৯৭৫ সালের ৯ মার্চ অসুস্থতাজনিত কারণে আকস্মিকভাবে মৃত্যু বরণ করেন তিনি। পরিবার সূত্রে জানা যায়, মরহুম বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসলাম মিয়ার মৃত্যুর পর তাঁর সহধর্মীনি চাঁন বানু বেগম দেশের প্রতি ভালোবাসার টানে পরিবারের বড় ছেলে মো. দেলোয়ার হোসেনকে বাংলাদেশ আর্মিতে (এমওডিসি) কোরে ভর্তি করিয়ে দেন। মায়ের অসুস্থতার জনিত কারণে বাড়ি থেকে ছুটি কাটিয়ে আসার পর যথাসময়ে ডিউটিতে জয়েন্ট করতে না পারায় তার উপর নেমে আসে সামরিক বাহিনীর নিয়মানুযায়ী ডিপার্টমেন্টাল পানিসমেন্ট।
পরে সেনানিবাসের কোয়ার্টার গ্রাড হতে অসুস্থ অবস্থায় তাকে ঢাকার সিএমএইচ হাসপাতালের (মানসিক বিভাগে) ভর্তি করা হয়। উন্নত চিকিৎসার অভাবে পরবর্তীতে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তাকে অযোগ্য ও অক্ষম ঘোষনা করে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। বর্তমানে সে মানসিক প্রতিবন্ধী অবস্থায় খুবই কষ্টে দিনাতিপাত করছে। সামরিক বাহিনী থেকে কোন প্রকার সুযোগ-সুবিধা পায়না সে। বর্তমানে সে তার বৃদ্ধা ও অসুস্থ মায়ের উপরই সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল।
স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. মাহফুজ মজুমদারের মানবিক সহায়তায় ইতিমধ্যেই তার প্রতিবন্ধী সনদ ও পরিচয়পত্র সংগ্রহের কার্যক্রমে হাত দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এদিকে চাঁন বানু বেগম শুধুমাত্র স্বামীর সামরিক বাহিনী থেকে সামান্য পেনশন ও সরকার প্রদত্ত মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ছাড়া আর কোন সহযোগিতা পান না। জরাজীর্ণ, পুরাতন একটি বসতবাড়িতে স্বামী পরিত্যাক্তা এক কন্যা, বিধবা এক কন্যা ও মানসিক প্রতিবন্ধী ছেলে দেলোয়ার সহ কোনো মতে কষ্টে দিনাতিপাত করছেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধা বান্ধব সরকার গৃহহীন-অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবারের পূণঃবাসন এর লক্ষ্যে প্রতিটি বাড়িতে ১৫ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ১৪ হাজার বাড়ি নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।
চাঁন বানু বেগম সরকারের সে পূণঃবাসন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি গৃহ পেতে চান। তাঁর সন্তানদের নিয়ে একটু ভালোভাবে বাঁচতে চান। এদিকে মরহুম বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসলাম মিয়ার মেজো ছেলে মো. আব্দুল জলিল বাবা ও সৈনিক ভাইয়ের অনুপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ হৃদয়ে লালন করে জীবন পরিচালনা করে আসছেন। আব্দুল জলিলেরও স্বপ্ন ছিল বাবা ও বড় ভাইয়ের মত দেশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার। বিধিবাম তা আর হয়ে উঠেনি।
তবে, দেশকে ভালোবেসে ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ঐতিহ্য সকলের কাছে তুলে ধরতে যৌথভাবে প্রামাণ্য চিত্র নির্মাণ সহ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন তিনি। দেশের মঙ্গলের জন্য নানান ত্যাগ স্বীকার করা এমন একটি পরিবার চৌদ্দগ্রাম তথা সারাদেশের গর্ব। ইতিহাস এর অংশ হয়ে যাওয়া এই পরিবারটির দাবি মরহুম বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসলাম মিয়াকে যেন ব্রিটিশ সেনা সদস্য ও বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মরনোত্তর সম্মাননা প্রদান করা হয় এবং তার সমাধিস্থলকে চিহিৃত করে সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়।
মরহুম বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসলাম মিয়ার বড় ছেলে দেলোয়ার এর উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা ও মাসিক প্রতিবন্ধী ভাতা ও সেনা অনুদানের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। এবিষয়ে স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. মাহফুজ মজুমদার বলেন “দেশ মাতৃকার প্রয়োজনে নিজের জীবন বাজি রেখে অনেক ত্যাগ স্বীকার করে আমৃত্যু দেশের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন মরহুম বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসলাম মিয়া। তাঁর সন্তানরাও দেশকে ভালোবাসেন বাবার মতই।
এমন একটি পরিবারের জন্য সরকারী কোন সুযোগ সুবিধা পাইয়ে দিতে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো”। মরহুম বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসলাম মিয়ার সমাধিস্থল চিহিৃত করার বিষয়ে জানতে চাইলে চৌদ্দগ্রাম উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. আবুল হাশেম বলেন “সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থল চিহিৃত করার প্রক্রিয়া হাতে নিয়েছে। ইতিমধ্যে চৌদ্দগ্রাম উপজেলার তিন শতাধিক মুক্তিযোদ্ধার তালিকা কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। কেন্দ্রীয় নির্দেশনা পেলে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে”।