কুমিল্লা ট্রেনের ধাক্কা-অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে প্রাণ গেলো-৭

কুমিল্লা প্রতিনিধি, আবদুল মান্নান, ২৭ নভেম্বর, ২০২৪ (বিডি ক্রাইম নিউজ ২৪) : ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের কুমিল্লার বুড়িচংয়ে অরক্ষিত একটি লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় ব্যাটারি চালিত অটোরিকশার চালকসহ ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) সকাল ১০ টার দিকে উপজেলার কালিকাপুর রেল ক্রসিং এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহতদের মধ্যে একজন ৮ মাসের অন্তসত্ত্বা নারী রয়েছেন। এছাড়া দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছেন আরো এক নারী। তার অবস্থাও আশঙ্কাজনক বলে জানা গেছে।

নিহতরা হলেন-বাকশিমুল গ্রামের পূর্বাপাড়ার মনির হোসেনের স্ত্রী শাহিনুর আক্তার (৩৩), উত্তর পাড়ার মনসুর আলীর পুত্র আলী আহাম্মদ (৭৭), মৃত আবদুল মালেকের স্ত্রী লুৎফা বেগম (৬০), তৈয়ব আলীর পুত্র শাহজাহান (৪০), বাকশিমুল মির্জাপুকুর পাড় এলাকার আলী আশরাফের স্ত্রী সফর জান বেগম, পাশর্^বর্তী খোদাইতুলী গ্রামের আসমত আলীর পুত্র রফিজ আলী (৬৫) এবং মৃত ফজলু মিয়ার স্ত্রী হোসনে আরা (৬০)।

এদিকে রেলপথের কালিকাপুর এলাকায় অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ের কারণেই এই দুর্ঘটনা বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। আর রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, দুর্ঘটনা স্থলে রেলওয়ের কোনো বৈধ লেভেল ক্রসিং নেই। এ ঘটনায় একটি অপমৃত্যুর মামলা করেছে রেল কর্তৃপক্ষ। গঠন করা হয়েছে ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি। অটোরিকশায় ট্রেনের ধাক্কায় ৭ জনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বুড়িচং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আজিজুল হক।

তিনি জানান, চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী বিরতিহীন সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনটি সকাল দশটায় বুড়িচং উপজেলার কালিকাপুর এলাকায় একটি ক্রসিং দিয়ে পার হওয়ার সময় যাত্রীবাহী অটোরিকশাকে ধাক্কা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই অটোরিকশার চালকসহ ৬ যাত্রী নিহত হন। এছাড়াও হাসপাতালে নেওয়ার পথে আহত একজনের মৃত্যু হয়। দুর্ঘটনায় আহত অপর এক নারীকে কুমিল্লার একটি প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, মঙ্গলবার সকাল দশটার দিকে বাকশিমুল গ্রাম থেকে পার্শ্ববর্তী গাজীপুরের উদ্দেশ্যে ব্যাটারিচালিত ৭ সিটের অটোরিকশায় করে যাচ্ছিলেন আট জন। পথিমধ্যে কালিকাপুর এলাকায় পৌঁছালে অরক্ষিত ওই লেভেল ক্রসিংয়ে আটকে যায় অটোরিকশাটি। এসময় চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনটি অটোরিকশাটিকে ধাক্কা দেয়। মুহূর্তেই দুমড়ে-মুচড়ে যায় অটোরিকশাটি। ঘটনাস্থলে মারা যান অটোরিকশা চালক ও ৬ যাত্রী। পরে হাসপাতালে নেয়া হলে মৃত্যু হয় আরও এক নারীর।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বাকশীমূল থেকে গাজীপুরগামী সড়কে রেলের যে লেভেল ক্রসিং রয়েছে সেখানে কোন গেইট নেই। যে কারণে ট্রেন আসা যাওয়ার সময় অপর পাশ থেকে সড়কে চলাচলকারী যানবাহন ট্রেনের চলাচল দেখতে পায় না। যে কারণে এ দুর্ঘটনা। এদিকে দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থলে আসলে স্থানীয়দের তোপের মুখে পড়তে হয় রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের। এসময় রেলপথ অবরোধ করে রাখেন বিক্ষুব্ধ জনতা।

স্থানীয়দের দাবি, লেভেল ক্রসিংয়ে গেট দেয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছিলেন তারা। রেল কর্তৃপক্ষের উদাসিনতাকে দায়ী করছেন তারা। পরে পরে বুড়িচং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাহিদা আক্তারসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং পুলিশ ও সেনাবাহনীর সদস্যরা ঘটনা স্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। নিহত শাহিনুর আক্তারের মামা স্থানীয় বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন বলেন, দুর্ঘটনার খবর পেয়ে আমি দ্রুত ঘটনাস্থলে আসি। এসে জানতে পারি আমার ভাগনিও অটো-রিকশাটিতে ছিলো। সে ৮ মাসের গর্ভবতী ছিলো। কিন্তু ঘটনাস্থলে এসে চারজনের লাশ দেখতে পাই। সেখানে শাহিনুরের লাশ দেখতে পাইনি। পরে একজনের মোটরসাইকেলের সহায়তায় প্রায় এক কিলোমিটার দূরে গিয়ে শাহিনুর এবং আলী আহাম্মদ নামে একজনের লাশের সন্ধান পাই।

তিনি বলেন, বাকশিমুল এই সড়কটি অরক্ষিত ভাবে রেললাইন অতিক্রম করেছে। এখানো কোনো গেইট নেই, গেইটম্যানও নেই। যার ফলে অহরহ দুর্ঘটনা ঘটছে। এখানে রেলওয়ে সিগনালের ব্যবস্থা করা উচিৎ। একই দাবি জানিয়েছেন অন্যান্য বাসিন্দারাও। জাহাঙ্গীর আলম জাবির নামে একজন বলেন, এই সড়কটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সড়ক। এ সড়ক দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ যাতায়াত করেন। কিন্তু রেলওয়ে ওভারপাস বা রেলগেইট না থাকার কারণে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। এলাকার মানুষ দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসলেও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে আমাদের এ দাবি বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

এদিকে দুর্ঘটনাস্থলে রেলওয়ের কোনো বৈধ লেভেল ক্রসিং নেই বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন লাকসাম রেলওয়ে থানার ওসি এমরান হোসেন। তিনি বলেন, যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেই লেভেল ক্রসিংটি অবৈধ। ট্রেন আসার বিষয়টি বুঝতে না পেরে হঠাৎ রেললাইনে উঠে পড়েন অটো-রিকশা চালক। এতে করে ট্রেনের ধাক্কায় অটো-রিকশাটি দুমড়ে-মুচড়ে যায়। আমরা ঘটনা স্থলে একজনের মরদেহ পেয়েছি। বাকিদের মরদেহ স্বজনেরা নিয়ে গেছেন। এ ঘটনায় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এদিকে দুর্ঘটনায় ৭ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় একটি অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করে ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি নিশ্চিত করে বাংলাদেশ রেলওয়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (পূর্ব) মোহাম্মদ নাজমুল ইসলাম বলেন, এ ঘটনায় একটি অপমৃত্যুর মামলা করা হয়েছে। সেই ঘটনার তদন্তে ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা অবিলম্বে প্রতিবেদন জমা দিবেন।

অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের বিষয়ে কোনো ইতিবাচক সিন্ধান্ত নেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মোঃ আমিরুল কায়ছার জানান, লেভেল ক্রসিংগুলোকে নিরাপদ করতেই হবে। এজন্য রেল কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট উদ্যোগ নিতে হবে। কারো দায়িত্ব অবহেলার দায় জীবনের বিনিময়ে হতে পারে না। এই দুর্ঘটনার তদন্তে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *