শাবিপ্রবি’র ছাত্র আন্দোলন ও প্রাইমারি কালচার : মোশাররফ হোসেন মুসা
মতামত (আমলা, সুশিল সমাজ), ২৮ জানুয়ারী, ২০২২ (বিডি ক্রাইম নিউজ ২৪) : মিষ্টভাষী হওয়া, অপরের বক্তব্য ধৈর্য সহকারে শোনা, কাউকে ব্যঙ্গ না করা, ভুল স্বীকার করা ইত্যাদিকে উন্নত বিশ্বে ‘প্রাইমারি কালচার’ হিসেবে গণ্য করে। এদেশে অহরহ প্রাইমারি কালচার ভঙ্গের ঘটনা ঘটে থাকে। সামান্য কুটুক্তিকে কেন্দ্র করে তুলকালাম কাণ্ড ঘটাসহ বিরোধী পক্ষকে খুন করার মতো জঘন্য ঘটনা ঘটতেও দেখা যায়। অথচ নিজ দেশে যারা প্রাইমারি কালচার মান্য করছেন না, তারা বিদেশে গিয়ে কিন্তু ঠিকই সেটা মেনে চলেন। সর্বশেষ শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনে সেটাই প্রমাণীত হলো। গত ১৩ জানুয়ারি রাতে শাবিপ্রবিতে আন্দোলন শুরু হয়।
জানা গেছে, সিরাজুন্নেসা হলের ছাত্রীরা হলের সমস্যা নিয়ে প্রভোস্ট জাফরিন লিজার সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি না কি ছাত্রীদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। এর প্রতিবাদে রাত সাড়ে দশটার দিকে ছাত্রীরা বিক্ষোভ শুরু করেন এবং রাত ১১ টার দিকে উপাচার্য ফরিদ উদ্দীন আহমেদের বাসভবন চত্ত্বরে অবস্থান নিয়ে শ্লোগান দিতে থাকেন। ১৪ জানুয়ারি দুপুর ১২টায় উপাচার্যের সঙ্গে ঘন্টাব্যাপী বৈঠকে কোনো সমাধান না হওয়ায় কর্মসূচি চলমান রাখেন।
বিকেল পাঁচটায় উপাচার্য জানান, সিরাজুন্নেসা হলের সহকারি প্রভোস্ট যোবাইদা কনক খানকে ভারপ্রাপ্ত প্রভোস্ট হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ১৫ জানুয়ারি বিকেল সাড়ে পাঁচটায় গোলচত্ত্বর সংলগ্ন রাস্তায় সড়ক অবরোধ করে প্রভোস্ট কমিটির পদত্যাগ চায় শিক্ষার্থীরা। সন্ধায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করা হয়। প্রক্টর ড. আলমগীর কবিরের উপস্থিতিতে ছাত্রলীগের কর্মীরা এই হামলা করে বলে অভিযোগ করেন শিক্ষার্থীরা।
১৬ জানুয়ারি সকাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলচত্ত্বর সংলগ্ন প্রধান সড়ক অবরোধ করে সকল ধরণের যানবাহন প্রবেশে বাধা দেয়া হয়। বিকেলে উপাচার্য আইসিটি ভবনে গেলে সেখানে অবরুদ্ধ করেন শিক্ষার্থীরা। বিকেল পাঁচটায় উপাচার্যকে মুক্ত করতে পুলিশ সেখানে গেলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পুলিশ ২১ টি সাউন্ড গ্রেনেড ও ২৭ রাউন্ড শটগানের বুলেট ব্যবহার করে। এতে ১০-১২ জন শিক্ষার্থী আহত হন। আন্দোলনের মুখে প্রভোস্ট জাফরিন লিজা পদত্যাগ করেন। তাঁর স্থলে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নাজিয়া চৌধুরীকে নতুন প্রভোস্ট নিয়োগ দেওয়া হয়।
রাতে জরুরি সিন্ডিকেট সভা ডেকে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয় এবং পরদিন দুপুর ১২ টার মধ্যে হল ছাড়তে নির্দেশ দেয়া হয় (সূত্রঃ ভোয়া, ২৪ জানুয়ারি’ ২২)। এরপর ছাত্ররা হল ছাড়তে অস্বীকৃতি জানিয়ে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি জানিয়ে উপাচার্যের কার্যালয় ও সকল প্রশাসনিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেয়। শিক্ষার্থীরা পরদিন থেকে উপাচার্যের পদত্যাগ ও পুলিশের মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে আমরণ অনশন কর্মসূচি শুরু করেন। শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ ৭ দিনের অনশন দেখে দেশের বিভিন্ন মহল থেকে সহানুভূতি জানানো হয়।
সিলেটের ক্ষমতাসীন দলের নেতৃবৃন্দও তাদের অনশন ভাঙ্গতে অনুরোধ করেন। অনশনে অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় ১৬ জন শিক্ষার্থীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবশেষে বরেণ্য শিক্ষা অনুরাগী ও বিশিষ্ট লেখক ড. জাফর ইকবালের অনুরোধে দীর্ঘ ১৬৩ ঘন্টার অনশন ভাঙ্গেন শিক্ষার্থীরা।
আমরা দেখলাম, ফারজানা ইসলাম ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করলেন। তিনি কোনো প্রকার ভূল স্বীকার করেন নি। উপাচার্য পুলিশ দিয়ে ছাত্রদের লাঠিপেটা করার বিষয়ে কোনো দুঃখ প্রকাশ করেন নি এবং ভূল স্বীকারও করেন নি। তবে তিনি ছাত্রীদের সম্পর্কে এক অশালীন মন্তব্যের বিষয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। যদি ফারজানা ইসলাম শুরুতে অশালীন আচরণ না করতেন, তাহলে এরকম তুলকালাম কাণ্ডের সূত্রপাত হতো না।
আরও দেখা গেছে, শিক্ষার্থীরা পুলিশের সামনে হাটু গেড়ে ফুল দিয়ে তাদের স্বাগত জানাচ্ছেন। এই ফুলতো আন্দোলনের শুরুতে উপাচার্য সহ বিভিন্ন শিক্ষকদেরও দিতে পারতেন। যেসব শিক্ষকরা নিজ দেশে ভূল স্বীকার করেন না এবং ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশি আচরণ করেন। তাঁরা নিশ্চয় বিদেশে গিয়ে এই আচরণ করেন না। এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য এদেশের শিক্ষার্থীরা সদাচরণ পাওয়ার যোগ্য নন।
প্রশ্ন হলো, শিক্ষার্থীদের সদাচরণ শেখানোর দায়িত্ব কি শিক্ষকদের নয়? ড.জাফর ইকবাল ও তাঁর স্ত্রী অধ্যাপক ইয়াসমীন হক ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিদায় নিয়েছেন প্রায় তিন বছর আগে। ড. জাফর ইকবাল একজন সজ্জন ও মিষ্টভাষী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। তিনি পরনিন্দা, পরচর্চা ও দলাদলী থেকে নিজেকে দুরে রাখেন। তিনি সব সময় শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দেন এবং আশাবাদের কথা শোনান।
যে কোনো ব্যক্তি স্বীকার করবেন, কেবল তাঁর কারণেই শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা পরিচিতি পায়। ফলে ছাত্রদের মাঝে তার একটি সম্মানজনক গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। তিনি অনশন ভঙ্গ করানোর সময় বলেছেন- সরকারের উপর মহলের অনুরোধে তিনি এখানে এসেছেন।
সরকার শিক্ষার্থীদের দাবিসমূহ মেনে নেবেন বলেন বলে আশা করেন। এই দায়িত্ব নিয়ে অন্য কোনো শিক্ষক সেখানে গেলে শিক্ষার্থীরা অনশন ভাঙ্গতেন বলে মনে হয় না। বলা যায়, তাঁর সদাচরণ তথা প্রাইমারি কালচারের কারণেই শিক্ষার্থীরা অনশন ভঙ্গ করেছেন। লেখকঃ পরিচালক, প্রাইমারি কালচার ডেভেলপমেন্ট সেন্টার( পিসিডিসি)।