সলিমুল্লাহ খানের চোখে আহমদ ছফা

***মতামত***

ঢাকা, ২৪ জুলাই ২০২৪ (বিডি ক্রাইম নিউজ ২৪) : বাংলাদেশের বিশিষ্ট গবেষক ও চিন্তাবিদ ড. সলিমুল্লাহ খান “আহমদ ছফা: ২০ বছর পর” শীর্ষক এক মুক্ত আলোচনায় সারগর্ভ বক্তব্য পেশ করেন। সমকালীন সমাজ, সংস্কৃতি, দর্শন ও রাজনীতি নিয়ে পর্যালোচনা এবং কালজয়ী লেখক মহাত্মা আহমদ ছফার চিন্তার আলোকে গণতন্ত্র, সাম্য ও ধর্মীয় বৈচিত্র্যে দক্ষিণ এশিয়ার আধুনিকতম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ নেতৃত্ব দিতে পারে বলে আলোচনায় উল্লেখ করা হয়। বিলেতে ‘এথিক্‌স অব দি নেশন স্টেট’ পাঠচক্র গ্রুপের উদ্যোগে এই ভার্চ্যুয়াল আলোচনায় যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী লেখক, সাংবাদিক, সমালোচকগণ অংশ নেন। ড. সলিমুল্লাহ খানের বক্তব্য অনুলিখন আকারে নিচে উপস্থাপন করা হলো।

এক.

ড. সলিমুল্লাহ খান তার আলোচনায় বলেন, বাংলাদেশের ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলন ভারতের অনেকগুলো ভাষার আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করেছে। তার মধ্যে অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, আসামসহ অনেক এলাকার কথা বলা যায়। এমনকি কাশ্মীরিরাও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নতুন করে প্রেরণা লাভ করেছে। ভারতবর্ষ হচ্ছে বহু জাতির একটি মহাদেশ। মোগল সাম্রাজ্যের আগে এখানে আরও বহু সাম্রাজ্য ছিল। বৃটিশের আগে এখানে মোগলদের একমাত্র সাম্রাজ্য ছিল না। দক্ষিণ ভারতে চোলা সাম্রাজ্য, বিজয় নগর সাম্রাজ্য ছিল। সবশেষে ইংরেজ সাম্রাজ্য, যেটাকে আমরা বৃটিশ সাম্রাজ্য বলি। এখানে বৃটিশরা চলে যাওয়ার পর তারা সাম্রাজ্যটাকে দু’ভাগে ভাগ করেছে। একটার নাম ভারত আর আরেকটার নাম পাকিস্তান। দুটো রিপাবলিক রাষ্ট্র হলো। কিন্তু দুটোতেই সাম্রাজ্য রয়ে গেল। অর্থাৎ ৪৭ সনে সমাধানের তৃতীয় যে পথ ছিল, যেটা আদিতে কেবিনেট মিশনও বলেছিল যে, পৃথক পৃথক অঞ্চলে পৃথক পৃথক স্বায়ত্তশাসিত রাজ্য হবে। তাহলে সারা ভারত একটা ফেডারেশন বা কনফেডারেশন হবে। কেবিনেট মিশন প্ল্যান হিসেবে যেটা পরিচিত। এটা কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ উভয়েই মেনে নিয়েছিল। সেটা থেকে যখন কংগ্রেস রিনেইগ করলো তখন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের জন্য চাপ দিলেন। পূর্ব বাংলায় পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা মিলে স্বাধীন বাংলার যে আন্দোলন হচ্ছিল, সেটা তখন পরাস্ত হলো। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র কথায় ট্রানকেইটেড অ্যান্ড মথ ইটেন পাকিস্তান তিনি পেয়েছিলেন। আহমদ ছফা বলেছেন, যে কারণে ভারত ও পাকিস্তান ভাগ হলো তাতে সমস্যার সমাধান হয়নি। ১৯৭১ সনে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সৃষ্টি সেটারই একটা আংশিক সমাধান।

তিনি বলেন, ভারত উপমহাদেশে যখন মুসলিম শাসন চালু ছিল, সেটাও হাজার বছর হয়নি। প্রথমে একটা ধারণা পোষণ করা হতো যে, বাঙালিরা মানে শুধু হিন্দুরা। এখনো অনেকে তাই মনে করেন। কিন্তু বাঙালি মুসলমানরা যে প্রচুর বাংলা লিখেছেন তার ইতিহাস অনেকে জানে না অথবা চাপা দেয়া হয়। যেমন শাহ মোহাম্মদ সগীর পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইউসুফ জুলেখা লিখেছেন। ইউসুফ জুলেখা অনেকেই লিখেছেন। এরকম আমরা শুধু আলাওল বা দৌলত কাজীর কথা জানি। তারা সপ্তদশ শতাব্দীর লোক। কিন্তু তাদের আগেও তিনশ’ বছর ধরে এখানে বাংলায় মুসলমানরা অনেক ধর্মীয় উপাখ্যান থেকে বেরিয়ে এসে প্রণয় উপাখ্যান লিখেছেন। যেমন ইউসুফ জুলেখার কাহিনী। এটা প্রণয় উপাখ্যানও আবার এতে সেমিটিক ধর্মীয় ঐতিহ্য রয়েছে। আমরা যতটুকু জানি যে, বৌদ্ধ ধর্মের ভেতর দিয়ে বাংলা সাহিত্যের বিকাশ হয়, যেমন চর্যাপদ। তারপর বাংলা সাহিত্য বিকাশে মুসলমানরাও অংশগ্রহণ করেছেন। উনিশ শ’ শতাব্দীতে আধুনিক বাংলা সাহিত্য বিকাশে খ্রিস্টানরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। যেমন বাইবেল অনুবাদ, উইলিয়াম কেরি ইত্যাদি। সেদিক দিয়ে দেখা যায় যে, বাংলা সাহিত্য নানা ঐতিহ্য দিয়ে তৈরি হয়েছে। প্রথমে বৌদ্ধ, তারপরে ব্রাহ্মণ ও মুসলমান পরবর্তীকালে খ্রিস্টান এবং অন্যদের উপাদান এতে আছে।

দুই.

তিনি বলেন, আজ যাদেরকে আমরা সম্প্রদায় বলি, এই সম্প্রদায় কথাটি তখন চালু ছিল না। এই সম্প্রদায়কে তখন জাতি বলা হতো। হিন্দুদের মধ্যে স্মার্থ, বৈষ্ণব এগুলো সম্প্রদায়। হিন্দু আর মুসলমানকে দুই সম্প্রদায় বলা হতো না। সেটা বলা হলে তো একটা জাতি থাকতে হবে। এগুলো আলাদাভাবে জাতি বলা হতো। আবার পুরনো বাংলা ভাষায় দেখবেন নারী জাতি, পুরুষ জাতি বলা হয়েছে। তাই জাতি একটা জটিল শব্দ। এখন আমরা বাঙালি জাতি বলছি তখন সেভাবে বলতো না। হিন্দু এবং মুসলমান যদি দুই জাতিও হয়ে থাকে, তাহলে তাদের বিকাশের মাত্রা সমান ছিল না। ভুলভাবে হলেও মনে করা হতো মুসলমানরা শাসক জাতি ছিল ৭০০ বছর। যেভাবেই হোক মোগল সম্রাটদের সঙ্গে আমাকে এক করে দেখা হতো। আমি তো বাংলার প্রজা। সেই হিসেবে হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে বিকাশে একটা পার্থক্য দেখা গেছে। তবে মোগল সময়ে কর্মক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলিম হিসেবে কোনো পার্থক্য ছিল না। যেমন মোগল প্রশাসনে দেখা যাবে যত উচ্চ মনসদার আছেন তাদের মধ্যে ইরানি, আফগানি, তুর্কি আছেন এবং ভারতীয় হিন্দু রাজপুতরাও সমানে সমানে আছেন। এই পার্থক্যটা ইংরেজ আমলে  তৈরি হলো। ইংরেজ আমলে এই পার্থক্যের ফল হলো যে, অন্তত একশ পঞ্চাশ বছর এগিয়ে থাকলো যারা জমিদারি এবং ব্যবসার মধ্যে ছিল। এরাই হলো বাংলাদেশে নতুন গঠিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়। যারা পিছিয়ে ছিল তাদের বলা হয় মুসলিম সম্প্রদায়। তাদের মধ্যে আবার বাংলায় দুই ভাগ ছিল। উর্দু ভাষী মুসলিম এবং বাংলা ভাষী মুসলিম। এই যে ফরিদপুরের নবাব আব্দুল লতিফ যিনি বললেন যে, উচ্চ শ্রেণির মুসলমানদের ভাষা হচ্ছে উর্দু আর নিম্নশ্রেণির মুসলমানদের ভাষা হচ্ছে বাংলা। সেটা কবে বলছেন? ১৮৮০’র দিকে। এই জন্য বলা যায় যে, সম্প্রদায়ের বিকাশে একটা পার্থক্য আছে। আইডিওলিজম বাদ দিয়ে বস্তুবাদী বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে যে অসম বিকাশ সেখান থেকে একটা দ্বন্দ্ব শুরু হলো। সেইজন্য বৃটিশরা ১৮৫৭ সনের বিদ্রোহের পরে এটাকেই মূলধন করলো।

ড. সলিমুল্লাহ খান বলেন, হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে যেহেতু পার্থক্যটা আছে এটাকে তারা এক্‌সপ্লয়েট করলো। তখন হিন্দুরা প্রথম স্বদেশি আন্দোলন শুরু করলো। তার দেখাদেখি মুসলমানরা শুরু করলো খেলাফত আন্দোলন। ওই সময়টাতে বৃটিশরা পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করলো। ১৯১৯ সনের প্রথম নির্বাচনে পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা হলো। একে আমরা বলি সেপারেট ইলেক্‌টরেট। মুসলমানরা শুধু মুসলমান ক্যান্ডিডেটদের ভোট দিবে। অন্যরা সাধারণ যার নাম ছিল জেনারেল সিট। এই প্রস্তাবটা এসেছিল ১৯০৯ সন থেকেই। ভারত শাসন আইনে প্রথম কার্যকরী হয় ১৯১৯ থেকে। এটাও আমাদের ইতিহাসের একমাত্র কাহিনী নয়। এটা ১৯৩৫ সনে চললো। ১৯৫২ সনের পর থেকেই পূর্ব বাংলার সমস্ত প্রগতিশীল দল আওয়ামী লীগসহ তারা দাবি করলো যে, যৌথ নির্বাচন দিতে হবে। হিন্দু-মুসলিম সবাই একসঙ্গে এমপি নির্বাচিত করতে চাইলো। সেটাই সফল হতে হতে ১৯৫৪ পার হয়ে গেল। ১৯৫৪’র নির্বাচন পৃথক নির্বাচন হয়েছিল। ৭০ সনের নির্বাচনটা প্রথম যৌথভাবে হয়েছে ।

আমাদের দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার একটা ভুল ব্যাখ্যা দেয়া হয়। একপক্ষ ব্যাখ্যা করছেন ধর্মনিরপেক্ষতা মানে নাস্তিকতা। তার থেকে মধ্যখানে আরেকটি ব্যাখ্যা দেয়া হয় ইহজাগতিকতা বলে। মানুষকে ফাঁকি দেয়ার কিছু নাই। আমাদের এখানে ধর্মনিরপেক্ষতা কথাটা কীভাবে এসেছে সেটা বুঝতে হবে। ৫৪’র নির্বাচনের আগে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক দাবি তুলছিলেন যে, আমরা এখন পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থাটা বাদ দেই হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গে নির্বাচন করি। তখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, পাকিস্তান হওয়ার আগে আপনারাই তো পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘ঈসার দিনে ঈসা আর মুসার দিনে মুসা। তখন অবহেলিত বঞ্চিত পশ্চাদপদ মুসলমানের জন্য এটা দরকার ছিল। আমরা যখন এক হয়ে গিয়েছি। পাকিস্তানের সঙ্গে লড়তে হবে এখন আমাদের ঐক্য দরকার।’ হিন্দু-মুসলিমসহ সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীনতার জন্য লড়েছে এবং পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা বাদ দিয়ে যৌথ নির্বাচন প্রথা চালু করেছে। ধর্মের বৈচিত্র্যের মধ্যেই আমাদের ঐক্য। এটা হচ্ছে আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতার সারকথা। ফ্রাগমেটিক কথা।

তিন.

সলিমুল্লাহ খান বলেন, রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অনেকের কথা আমরা জানি। আমাদের সমাজের দুঃখ হচ্ছে উনিশ শ’ শতকে রাজা রামমোহনের শিষ্যদের মধ্যে একজনও অবর্ণ হিন্দু পাবেন না। মানে তফশিলি হিন্দু পাবেন না। কারণটা কী? এটা ছিল উচ্চবর্ণ সমাজের নবজাগরণ। শুধু হিন্দু-মুসলমান বলছি না, হিন্দুবর্ণ সমাজের মধ্যে উচ্চবর্ণের। কিন্তু মুসলিম সমাজে এরকম কোনো নেতার উদ্ভব হয়নি কেন? লেখক কিছু উদ্ভব হয়েছে। যেমন রূপ জালাল যিনি লিখেছেন বেগম নবাব ফয়জুন্নেছা, তিনি লাকসামের মানুষ। তিনি বঙ্কিমের চেয়ে চার বছরের বড়, বেগম রোকেয়ার জন্মের চার বছর আগে রূপ জালালের বই বের হয়েছে। ওই রকম বই হিন্দুরাও লিখতে পারে নাই। এটার কথা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে পাবেন না। তিনি মীর মোশাররফ হোসেনের সিনিয়র, বঙ্কিমের সিনিয়র। বাঙালি মুসলমানরা বাংলা লিখতো না, কথাটা ঠিক নয়। কথায় আছে, দশচক্রে ভগবান ভুত। প্রচার হয়েছে বাঙালি মুসলমানরা বাংলা ভাষাকে ঘৃণা করেছে। আসল সত্য হলো- মুসলমানরা বাংলা ভাষাকে ঘৃণা করে নাই। বাঙালি মুসলমান বাংলাই বলতো সবসময়। কিন্তু কিছু কিছু নেতা নবাব আব্দুল লতিফ, সৈয়দ আমীর আলী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এরা উর্দুুভাষী ছিলেন। সমাজের রূপান্তর বোঝার জন্য এই দ্বন্দ্বগুলো জানতে হবে।

তিনি বলেন, মুসলমান হওয়ার জন্য বাঙালিত্ব বাদ দেয়ার দরকার নাই। আবার বাঙালি হওয়ার জন্য মুসলমানিত্বও বাদ দেয়ার দরকার নাই। অন্যদিকে বাংলার সংস্কৃতি আর বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। অনেক বাঙালি এটা বুঝতে পারে না। বাংলার সংস্কৃতি মানে বাংলাদেশে যে গাঢ়, হাজং, মগ, মুরং, চাকমা, সাঁওতাল আছে তাদেরকে বাদ দিয়ে নয়। ৭২ সনে আহমদ ছফা লিখেছেন, আমাদের শুধু হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি দিয়ে বাংলাদেশ ঘটতো না। আমাদের মধ্যে যারা অবাঙালি বলে এমনকি যারা উর্দুভাষী এদেশে থেকে যাবেন তাদেরকেও সম্পূর্ণ মানবিক মর্যাদা দিয়ে রাখতে হবে। তাই বলা যায়, আহমদ ছফার মতো একটা লোকের দৃষ্টিভঙ্গি যদি বাংলাদেশ অনুসরণ করতো বাংলাদেশে এখন যে দুরবস্থা হয়েছে তা হতো না।

চার.

সলিমুল্লাহ খান বলেন, বাংলাদেশের অনেক কিছু বাংলাদেশের একার ওপর নির্ভর করে না। পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের ঘটনাবলী এখানে একটা প্রভাব তৈরি করে, এটা অস্বীকার করা যাবে না। অপরাধ যা হচ্ছে এটা সংঘটিত। এটার একটা  বৈশ্বিক মাত্রা আছে। বৈশ্বিক মাত্রাটা কি? বৃটিশ আমলে চিরকাল ডিভাইড অ্যান্ড রুলের শিকার হয়েছি আমরা। হিন্দু-মুসলিম দ্বন্ধকে কেন্দ্র করে তারা তাদের প্রশাসনকে ক্রমশ বিলম্বিত করে করে ৪৭ সন পর্যন্ত এখানে শাসন করেছে। ৪৭ সনে এখানে দেশভাগ কেন মেনে নিলেন? ভারতের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ দীপান চন্দ্র বলছেন, শুধুমাত্র রক্তপাত এড়াবার জন্য কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ (তারা বলেন ইন্ডিয়ান ন্যাশনালিস্ট) এই দেশভাগের সিদ্ধান্তটা মেনে নিয়েছেন। কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়। দেশ ভাগের পর রক্তপাত কমেনি বরং ক্ষেত্রবিশেষে বেড়েছে। বাংলাদেশের উদাহরণ যদি ভারতীয়রা অনুসরণ করে তাহলে ভারতে আরও কয়েকটি অংশ স্বাধীন হয়ে যেত। সেখানে অনেক ঘটনার ব্যালেন্স আছে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব বাড়ছে। ওখানে যখন ধর্মের প্রভাব বাড়ে, বিজেপিকরণ বাড়ে তখন এর একটা প্রভাব এদেশেও এসে পড়ে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী এখানে আসবেন তিনি বিভিন্ন মন্দিরে যাবেন। এটা পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই হচ্ছে এখানে। এজন্য বলছি বাংলাদেশে কী হবে এটা শুধু বাংলাদেশের মধ্যেই নির্ধারিত হয় না।

অপরাধের একটা এজেন্ট আছে যাদেরকে আমরা অপরাধী বলি। অপরাধের কিছু সহযোগী একম্প্লিস আছে। ভারতে যা ঘটে তার প্রভাব বাংলাদেশে হয়। যেমন বাবরি মসজিদের ঘটনা আমরা জানি। তসলিমা নাসরিনের বই ভারতে লক্ষ লক্ষ কপি অনুবাদ হলো কেন? বাংলাদেশে তসলিমা নাসরিন তার লজ্জা বা অন্যান্য বইয়ে যে অভিযোগটা করেছেন সেগুলো ভারতে উড়িষ্যার মুখ্যমন্ত্রী নন্দিনী সতপতির মতো বিদূষী মহিলাও অনুবাদ করেছেন। এটা বিজেপি লাখ লাখ কপি ফ্রি বিলি করেছে। ভারতের যেকোনো জায়গায় আপনি ইংরেজি ও হিন্দিতে লজ্জা দেখতে পাবেন। কারণটা কি? কারণ আছে। বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন এটা প্রচার হলে ভারতে মুসলিম নির্যাতন সহনীয় হয়ে ওঠে। এইজন্য বলছি ভারতে যা ঘটে তার একটা স্ল্লিপ ওভার ইফেক্ট এসে পড়ে বাংলাদেশে । সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের ক্ষেত্রে এটাও একটা কারণ। আমি বলবো বৈশ্বিক ঘটনা বা ভারতের ঘটনা প্রধান ব্যাপার নয়। প্রধান ব্যাপার আমাদের। আমরা যদি হাজার বছরের সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে থাকি তাহলে এতগুলো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এখানে হলো কেন? সাহিত্যের মধ্যেও এর প্রকাশ ঘটে কেন? এইজন্য বলি- আমাদের এসব অঞ্চলে সবসময় সাপ্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছে। তবে স্বতঃস্ফূর্ত দাঙ্গা হয় নাই। পূর্ববাংলা সেদিক থেকে অনেক ভালো। ১৯৪৬ সনে নোয়াখালীতে যে দাঙ্গা হয়েছিল, তাতে সর্বোচ্চ ৩০০ লোক মারা গিয়েছিল। মহাত্মা গান্ধী যেখানে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু কলকাতাতে কতলোক মারা গিয়েছিল এবং বিহারে কত মারা গিয়েছিল? যেখান থেকে আমরা বিহারি সমস্যা পেয়েছি। এই কথাগুলো বাদ দিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার কথা ব্যাখ্যা করা যাবে না।

তিনি বলেন, একাত্তরে আমাদের অঙ্গীকার ছিল যে, আমরা পৃথক নির্বাচন থেকে যৌথ নির্বাচনে যাবো। সত্তরের নির্বাচন প্রথম যৌথ নির্বাচন হয়। আইয়ুব খান এটা মেনে নিয়েছিলেন। তারপর সত্তরে এটা বাস্তবায়ন হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা একটা দেশ স্বাধীন করেছিলাম যেখানে কোনো বিভেদ থাকবে না। এই বিভেদ এখন বাড়াবার চেষ্টা হচ্ছে। এটা আশ্চর্যের ব্যাপার। ধর্মের কারণে কারও উপর আক্রমণ হবে, বাংলাদেশে এটা অভূতপূর্ব ঘটনা। এ রকম ঘটনা আগে ঘটেনি। আগে যে রকম ঘটতো যেমন মসজিদের সামনে বাজনা বাজানো, গরু কাটা নিয়ে। সেগুলো সংঘটিত আন্দোলন ছিল। গো-রক্ষিণী সভা, ইংরেজের প্রেরণায় ১৮৮০ দশক থেকে ভারতে ঘটিত হয়েছিল। তার থেকে আন্দোলন শুরু হয়েছিল। এখনো ভারতে সেটি হচ্ছে। আমাদের দৃষ্টিকে একটু প্রসারিত করতে হবে। ভারত এবং বাংলাদেশ প্রতিবেশী এবং ঘনিষ্ট রাষ্ট্র। কিন্তু আমাদেরকে যে মানুষ হিসেবে ভারত ট্রিট করে না এটা বলার সাহস হচ্ছে না কেন? আমরা এখন নিউ কলোনিয়ালের যুগে আছি। এটা অস্বীকার করার উপায় নাই। কিন্তু মনে রাখতে হবে আমরা লড়াই করে স্বাধীন হয়েছি, রক্ত দিয়ে স্বাধীন হয়েছি। এখানে অনেক ষড়যন্ত্র হচ্ছে এবং হবে এটা হয়তো বন্ধ রাখা যাবে না। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে আমাদের আশপাশে যা ঘটে সবটাই আমাদের প্রভাব বিস্তার করে এবং ভারতীয়রা যেভাবে নিউ কলোনিয়াল ওয়েতে আমাদের ট্রিট করছে, আমাদের বাজারে বলেন, আকাশ সংস্কৃতিতে বলেন, সীমান্তে বলেন স্বাধীন দেশ হিসেবে এটা কেউ কারও সঙ্গে করে না।  (চলবে)

অনুলিখন: ড. এম মুজিবুর রহমান
লন্ডন প্রবাসী। সাবেক সহকারী অধ্যাপক, শাহ্‌জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *