বাংলাদেশে সুশীল সমাজের বিবর্তন ও কতিপয় রাজনৈতিক বিতর্ক
বাংলাদেশ প্রেক্ষিত
উপরোক্ত সংক্ষিপ্ত আলোচনা থেকে এটা প্রতীয়মান হয় যে ‘সুশীল সমাজ’ একদিকে যেমন একটি প্রত্যয়, অন্যদিকে একটি প্রক্রিয়া। প্রত্যয়টি সম্পর্কে গভীরতর উপলব্ধি প্রক্রিয়াটির গতিপথে বেগ এনেছে; অন্যদিকে প্রক্রিয়ার অগ্রাভিমুখী যাত্রা প্রত্যয়টিকে আরো বাস্তবমুখী করেছে। সুশীল সমাজ তথা নাগরিক আন্দোলনের বহুমাত্রিকতা সহজবোধ্য হয় যখন আমরা তার কর্মভিত্তিক প্রকাশকে বিবেচনায় নেই। এর মধ্যে রয়েছে শ্রমিক সংঘসহ পেশাজীবীদের সংগঠন, নির্দিষ্ট কোনো বিষয় বা গোষ্ঠীর লক্ষ্যে সমর্থনমূলক উদ্যোগ, বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত সম্প্রদায়গত উদ্যোগ, প্রচারমাধ্যম, জ্ঞানভিত্তিক প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান, অরাজনৈতিক ধর্মীয় সংস্থা ইত্যাদি। রয়েছে নারী অধিকার, পরিবেশ সংরক্ষণ, ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার আন্দোলন।
বাংলাদেশে সুশীল সমাজে কতগুলো প্রতিষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত তার কোনো হিসাব আমাদের জানা নেই। অনেক গবেষক এক্ষেত্রে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে নিবন্ধিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দিয়ে বাংলাদেশের সুশীল সমাজের আয়তন নিরূপণ করেছেন, যা নিতান্তই একটি সংকীর্ণ প্রচেষ্টা। অনেকে আবার আরো সংকীর্ণ সংজ্ঞার ভিত্তিতে এনজিও ব্যুরোতে নিবন্ধিত বিদেশী সাহায্যপুষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকেই শুধু সুশীল সমাজ ভেবেছেন। বলা বাহুল্য, সুশীল সমাজের একটি বড় অংশ (এর সংজ্ঞা অনুযায়ী) অপ্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তিতে বিকেন্দ্রায়িতভাবে ক্রিয়াশীল। তাই একটি পূর্ণাঙ্গ শুমারি ব্যতীত প্রত্যয়টির প্রকৃত আয়তন নির্ধারণ করা সম্ভব নয়, হয়তো প্রয়োজনও নেই। এ বিষয়ে পরে আসছি।
তবে বাংলাদেশের সুশীল সমাজের সবচেয়ে দৃশ্যমান ও প্রভাবশালী অংশটি দুর্নীতিমুক্ত সুশাসনের জন্য সচেষ্ট, রাষ্ট্রীয় নীতি পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক করেন, মানবাধিকার রক্ষায় সোচ্চার থাকেন। এরা মূলত উদার গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিকামী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। এ সম্পর্কেও আরেকটু পরে আলোচনায় আসছি।
বাংলাদেশের সুশীল সমাজের গৌরবোজ্জ্বল উত্তরাধিকারের কথা আমার বক্তব্যে প্রথমেই উল্লেখ করেছি। স্বাধীনতা সংগ্রামে এই সমাজের অনেকে অস্ত্র হাতে রাজনৈতিক নেতাদের পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিত্সা দিয়েছেন, প্রবাসী সরকারে দায়িত্ব পালন করেছেন। অর্থাত্ এটা ছিল বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের এক ক্রান্তিকাল, যেখানে রাজনৈতিক সমাজ আর সুশীল সমাজ অভিন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম করেছে।
মুক্তিযুদ্ধের এই চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ঘরেফেরা সুশীল সমাজের এই অনন্য ব্যক্তিরা শরণার্থী পুনর্বাসন ও যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনে যুক্ত হন। এ প্রবণতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো ব্র্যাক— যা আজ বিশ্বের সর্ববৃহত্ বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান। অপর উদাহরণ হলো গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, যেটি বিশ্বে গণমুখী চিকিত্সাসেবার একটি মডেল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
এরপর আমরা লক্ষ করি, ওইসব সংগঠন ও ব্যক্তি জরুরি পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন কার্যক্রম থেকে ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচন তথা একটি কল্যাণকর রাষ্ট্র গড়ে তোলায় সচেষ্ট হয়। ছাত্র-শিক্ষকসহ বিভিন্ন সামাজিক শক্তি তখন ‘দেশ গড়ার’ আন্দোলন সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়, গ্রামীণ জনগোষ্ঠী ও শ্রমিক শ্রেণীর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। গ্রামীণ ব্যাংকসহ অনেক প্রতিষ্ঠানই ক্ষুদ্রঋণ ও ক্ষমতায়ন কর্মসূচির মাধ্যমে এই পরিবর্তনের চেষ্টায় অগ্রণী হয়। এ প্রবণতারই ধারাবাহিকতায় কিছু প্রতিষ্ঠান আইনি সহায়তা প্রদান তথা মানবাধিকার রক্ষার আন্দোলনে ব্রতী হয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জাতীয় রাজনীতিতে যে পরিবর্তন আসে, তার ফলে সুশীল সমাজকে জনমানুষের অর্থনৈতিক দুর্গতি মোচনের পাশাপাশি গণতান্ত্রিক অধিকার পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে বিভিন্নভাবে যুক্ত হতে হয়। আপনাদের অনেকের হয়তো মনে আছে, স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তিকে একতাবদ্ধ করতে ১৯৮৭ সালের মার্চে ৩১ জন বুদ্ধিজীবী যে যুক্ত বিবৃতি দিয়েছিলেন, তত্কালে তা কী সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রেখেছিল। পরবর্তীতে সাংবিধানিক পথে একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে ১৯৯০ সালে তিন জোটের যে যুক্ত ঘোষণা আসে, তার রূপরেখাটিও কিন্তু একটি সুশীল সমাজের গোষ্ঠীর কাছ থেকেই আসে, যেখানে প্রয়াত ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমেদের ভূমিকা ছিল অন্যতম। আর আশির দশকজুড়ে ‘ঢাকা অবরোধ’সহ রাজপথের আন্দোলনে সংস্কৃতিসেবীরা, পেশাজীবীরা ও ছাত্র-যুবকর্মীরা তো ছিলেনই। তাই ১৯৯১-এর পঞ্চম জাতীয় সংসদের নির্বাচনের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের যে নবযাত্রা সূচিত হয়, তাকে মূর্তরূপ দেয়ার ক্ষেত্রে সুশীল সমাজের ভূমিকা অবশ্যই স্মরণীয়, বিশেষ করে ছাত্র-শিক্ষক-সাংস্কৃতিক কর্মী-পেশাজীবীদের ভূমিকা ছিল বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
আর সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করতে হয় স্বাধীনতা যুদ্ধের অসমাপ্ত দায়— পাকিস্তানি বাহিনীর যুদ্ধাপরাধী দোসরদের বিচারের দাবিতে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলনের কথা। এ আন্দোলনের চূড়ান্ত প্রকাশ ছিল ১৯৯২ সালের মার্চে ‘গণআদালতে’ যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি ঘোষণা। স্মর্তব্য, গণআদালতের প্রতিটি সদস্যই ছিলেন সুশীল সমাজের অংশ। তাই ১৯৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আজ যে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ আমরা দেখি, তাকে বর্তমান অবস্থায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে সুশীল সমাজের বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের অনেক ত্যাগ ও অবদান রয়েছে।
আর এর মাঝে বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের দুর্দশা মোচনে বিভিন্ন উদ্যোগ তো ছিলই। ছিল একটি তথ্য অধিকার আইন পাসের এবং দুর্নীতি দমন কমিশন ও মানবাধিকার কমিশন গঠনের সফল আন্দোলন। আরো ছিল সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী উদ্যোগ। ছিল তেল-গ্যাস-বিদ্যুত্-বন্দর রক্ষা কমিটির কার্যক্রম।
সাম্প্রতিক প্রবণতা
তত্ত্ব যতই পরিপক্ব হোক না কেন এবং ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা যা-ই বলুক না কেন, বাংলাদেশের সুশীল সমাজের সংজ্ঞা নিয়ে জাতীয়ভাবে স্বচ্ছ ঐকমত্য এখনো লক্ষ করা যায় না। আগেই বলেছি, সুশীল সমাজের পরিধি শুধু সরকারিভাবে নিবন্ধিত অথবা বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট সংগঠনগুলোয় সীমাবদ্ধ নয়। এখানে সুশীল সমাজ ও সুশীল সমাজের সংগঠন (civil society organisation – CSO)’—দুটির মাঝে পার্থক্য করতে হবে। কারণ সুশীল সমাজ সর্বদা কাঠামোগতভবে সংগঠিত নাও হতে পারে। অনেক দেশেই বা অনেক পরিস্থিতিতে অনানুষ্ঠানিক স্বতঃস্ফূর্ত নাগরিক উদ্যোগ আন্দোলন পরিচালনা করে থাকে, যার প্রথাগত অর্থে কাঠামো, পূর্বঘোষিত কর্মসূচি ও কর্মপন্থা থাকে না; থাকে না স্বীকৃত নেতৃত্ব। সেই অর্থে সুশীল সমাজের অভিপ্রকাশে লক্ষ করা যায় তারল্য (fluidity) এবং নমনীয়তা (flexibility)।
এই অনানুষ্ঠানিকতার চরম প্রকাশ হচ্ছে ব্যক্তি নাগরিক যখন একাই নৈতিক অবস্থান থেকে কোনো অন্যায় বা বৈষম্যের প্রতিবাদ করে। একাই পোস্টার হাতে (কখনোবা পরিবারবান্ধবদের নিয়ে) দাঁড়িয়ে যায় প্রেস ক্লাবের সামনে অথবা শহীদ মিনারে। ২০১৪ সালের ৫ মে গুম-হত্যার বিরুদ্ধে সংসদ ভবনের সামনে নাগরিকরা যে মানববন্ধন করেন, সেটা ছিল এ রকমই এক অনানুষ্ঠানিক উদ্যোগ। তবে নাগরিক হলেই সে সক্রিয়ভাবে সুশীল সমাজের অংশ হয় না। নাগরিক তখনই সমাজ হয়, যখন সে নির্দিষ্ট বিষয়ে তার অবস্থান ও মতামতকে প্রকাশ্যভাবে উপস্থাপন করে। যখন সে সামান্য হলেও তার অবস্থানের জন্য ঝুঁকি নেয়। তথ্যপ্রযুক্তি প্রসারের যুগে, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, ব্লগারদের আমরা সুশীল সমাজে নবতম অন্তর্ভুক্তি হিসেবে বিবেচনা করতে পারি।
সুশীল সমাজের এই ব্যাপকতর সংজ্ঞা তাকে চিহ্নিতকরণ ও দায় নির্দিষ্টকরণে বিপত্তি সৃষ্টি করে বলে অনেকে মনে করেন। সেক্ষেত্রে যেটা উল্লেখ্য সেটা হলো, গোটা কয়েক ন্যূনতম বৈশিষ্ট্য আছে, যা দিয়ে সুশীল সমাজ ও তার অন্তর্ভুক্ত সংগঠনকে দ্রুত চেনা সম্ভব। প্রথমত. সে রাষ্ট্রের অংশ হতে পারবে না অর্থাত্ সরকার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বা পরিচালিত হতে পারবে না, এমনকি অর্থায়নসহ স্বার্থের সংঘাত সৃষ্টি হতে পারে এমন কোনো সম্পর্ক রাখতে পারবে না সরকারের সঙ্গে। অবশ্য বেশকিছু বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের অংশীদার হিসেবে দায়িত্ব নেয়ায় সুশীল সমাজের বৈশিষ্ট্যটি অনেক সময় প্রশ্নের মুখোমুখি হয়।
দ্বিতীয়ত. সুশীল সমাজ কোনো দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকবে না। এটার অর্থ এই নয় যে, সুশীল সমাজের কোনো রাজনৈতিক চিন্তা বা মূল্যবোধ থাকবে না। বলা বাহুল্য, আদর্শিক নীতিবোধ থেকে তাড়িত হলেই তো ব্যক্তি নাগরিক সুশীল সমাজ হিসেবে পরিগণিত হয়। বিষয়টি হচ্ছে সুশীল সমাজের কোনো সক্রিয় ব্যক্তির রাজনৈতিক দলীয় সদস্য পদ থাকাটা সমস্যাজনক। এটা আরো সমস্যা সৃষ্টি করে যখন সেই ব্যক্তি শাসক দলের কোনো দায়িত্বে থাকেন। এর ফলে সংগঠন বা আন্দোলনের স্বাধীন চিন্তা বা পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রটি সংকুচিত হয়ে যায়।
তৃতীয়ত. সুশীল সমাজের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্দিষ্ট ও স্বচ্ছ হতে হবে। একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশে সুশীল সমাজ প্রকাশ্যভাবে, রাষ্ট্রের ঘোষিত নীতিমালার আওতায় তার ইচ্ছাটিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, এটাই কাম্য। সেজন্য সে প্রচার ও সমাবেশের মাধ্যমে জনমত সৃষ্টি করবে, জনসম্পৃক্ততা বাড়াবে সেটাই স্বাভাবিক। তবে সরকার সুশীল সমাজের জন্য প্রাসঙ্গিক নীতিমালা যদি অযৌক্তিকভাবে নিয়ন্ত্রণমূলক করে, তবে তা তার কর্মকাণ্ডের অন্তরায় হতে পারে। আর সংগঠনটি যদি রাষ্ট্রের মৌলিক উপাদানগুলোয় বিশ্বাস না করে তবে তো সে সমস্যা আরো গভীর।
সাধারণভাবে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে সুশীল সমাজের তিনটি মৌলিক ও ন্যূনতম বৈশিষ্ট্য হলো— রাষ্ট্রবহির্ভূত সংগঠন, রাজনৈতিক দলের বাইরে অবস্থান ও ঘোষিত কর্মসূচির পক্ষে প্রকাশ্য ও স্বচ্ছ কর্মকাণ্ড পরিচালনা।
আমার বক্তৃতার শেষাংশে বাংলাদেশে সুশীল সমাজ নিয়ে কিছু চলমান বিতর্ক সম্পর্কে কয়েকটি ভাবনা-দুর্ভাবনা তুলে ধরতে চাই।
বিতর্কগুলো
কর্মপরিধি। সুশীল সমাজের কর্মপরিধি নিয়েও অনেক সময় বিভ্রান্তি লক্ষ করা যায়। অনেকেই অভিযোগ করেন এরা প্রায় ‘সব বিষয়ে’ কথা বলে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে সুশীল সমাজের প্রতিটি এককই কোনো না কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে উত্সাহী হয়েই সংগঠিত হয়েছে। এই বিষয় সূচি বেশ দীর্ঘ। মূলত তা হচ্ছে সমাজে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্রায়ণ, দুর্নীতি মুক্তকরণ, দারিদ্র্য বিমোচন, বৈষম্য হ্রাস, সমাজের অসুবিধাগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগ কমানো ইত্যাদি। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের সুশীল সমাজ সংগঠনের মধ্যে তিনটি ধারা লক্ষ করা যায়। প্রথম ধারায় আছে সেসব প্রতিষ্ঠান, যারা তৃর্ণমূল পর্যায়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নমুখী উদ্যোগ পরিচালনা করছে। এ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য তারা সদস্য সংগ্রহ করে থাকে। তাদের অনেকেরই আঞ্চলিক বা জাতীয় পর্যায়ে সংগঠন থাকে। এদের প্রচলিত ভাষায় implementing CSO/NGO বা (উন্নয়ন) কর্মসূচি বাস্তবায়নকারী সংস্থা বলে। বাংলাদেশের কয়েক হাজার বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান বা এনজিও এরা।
দ্বিতীয় ধারার সংগঠনগুলো হচ্ছে, যারা মূলত গবেষণা ও নীতি পর্যালোচনা করে। এরা যে শুধু think tank তা নয়। বিজ্ঞান চক্র, সাক্ষরতা আন্দোলন ইত্যাদি এর অংশ। এদের প্রায়ই knowledge-based CSOs বলে। সিপিডি এই কাতারে অন্তর্ভুক্ত।
তৃতীয় ধারায় রয়েছে যাদের আমরা advocacy CSO বলি। দুর্নীতি, বৈষম্য, বঞ্চনা, অধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে এরা জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে সোচ্চার থাকে এবং প্রতিরোধ সৃষ্টিতে সক্রিয় থাকে। এ ধারার অগ্রণী উদাহরণ হলো আইন ও সালিশ কেন্দ্র, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)। যেহেতু ধারাটি তাদের কাজের চরিত্রের কারণে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান, অনেকেই সুশীল সমাজ বলতে এদেরকেই বোঝেন। যেহেতু এ ধারার সংগঠনগুলো রাষ্ট্র পরিচালনার মূল প্রতিষ্ঠানের ওপর সামাজিক নজরদারির দায়িত্ব পালন করে, তাই বাহ্যত মনে হতে পারে তারা রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে অযাচিতভাবে মতামত দিচ্ছে।
উপরন্তু, মানবাধিকার, আইনের শাসন, দুর্নীতি প্রতিরোধ, রাষ্ট্রের সম্পদের সঠিক ব্যবহার ইত্যাদি বিষয় কার্যত রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিভিন্ন অঙ্গের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই কান টানলে মাথা আসার মতো এদের বিভিন্ন সম্পর্কিত বিষয়ে মন্তব্য করতে হয়। তবে সে মন্তব্য অবশ্যই তথ্যনির্ভর ও বস্তুনিষ্ঠ হতে হবে।
উল্লেখ্য, বাস্তবে অনেক সংগঠনই একই সঙ্গে একাধিক (বা তিনটি) ধারায়ই কাজ করে। তাই তাদের উলম্ব (vertical) সংযুক্তি দেখা যায়। আবার অনেকেই অভিন্ন বিষয়ে জোট গঠন করে কার্যক্রম পরিচালনা করে আনুভূমিক (horizontal) সংযুক্তি ঘটায়। সুশীল সমাজের সংগঠিত অংশের এই কাঠামোগত সংহতি নিঃসন্দেহে তাদের কণ্ঠস্বরকে আরো উচ্চকিত করে। আর যাদের স্বার্থে তা আঘাত করে, তারা বিচলিত ও ক্ষুব্ধ হয়। উল্লিখিত তিনটি শ্রেণীবিভাগে, বাংলাদেশে সুশীল সমাজের মূলধারাটি এখনো উদার গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিকামী চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত।
রাজনীতি
সুশীল সমাজ সামগ্রিকভাবে না হলেও তার কিছু নেতা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কাজ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সামাজিকভাবে সচেতন ও সক্রিয় ব্যক্তির জন্য দেশের আর ১০ জন নাগরিকের মতো রাজনৈতিক ভূমিকা পালনের ইচ্ছা থাকাটা অযৌক্তিক নয়। অনেক সময় আবার এ উপলব্ধি আসতে পারে রাজনৈতিক সমাজের অন্তর্ভুক্ত হয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে না পারলে মানুষের দুঃখ-কষ্ট স্থায়ীভাবে নিরাময় করা সম্ভব নয়। উল্লেখ্য, ১৯৭২-এর জনপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশকে ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংশোধনের মাধ্যমে বিদেশী সাহায্য লাভকারী কোনো উন্নয়নধর্মী প্রতিষ্ঠানের প্রধানের জাতীয় নির্বাচন করার অধিকার চাকরি ছাড়ার তিন বছর পর্যন্ত রহিত করা হয়েছে। এই বিধান সরকারি কর্মচারীদের জন্যও সমভাবে প্রযোজ্য।
রাজনীতিতে নিজস্ব অবস্থান শক্তিশালী করার লক্ষ্যে সংগঠনকে ব্যবহার করা অবশ্যই অনুচিত। প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে তাদের ‘সমাজ’ বদল করা উচিত। তবে সুশীল সমাজে রাজনীতি প্রবেশের অপর মাধ্যম হচ্ছে যখন রাজনৈতিক দলগুলো পেশাজীবীদের সমিতিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দলীয় ছত্রচ্ছায়ায় নিয়ে আসে, কোনো সময় তা করে সংগঠনগুলোকে বিভক্ত করে। ফলে এসব সংগঠন পরবর্তীতে তাদের সদস্যদের ও অংশীজনদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থ হয়। এতে তারা নামে সুশীল সমাজ থাকলেও কার্যত রাজনৈতিক সমাজের অঙ্গসংগঠনে পরিণত হয়। বাংলাদেশের একটি অন্যতম বড় বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা যখন পদে থেকেই সক্রিয় দলীয় রাজনীতি শুরু করেন তখন তার সংগঠনে বিপর্যয় নেমে আসে।
তবে সাম্প্রতিককালে ভারতের আম আদমি পার্টির আবির্ভাব অনুধাবনীয়। তথ্য অধিকার আইন ও জন লোকপাল আইনের জন্য আন্দোলন করতে করতে অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও তার সহকর্মীরা নাগরিক আন্দোলনের সীমাবদ্ধতাকে উপলব্ধি করেন। একই সঙ্গে জনমানুষের মাঝে প্রচলিত রাজনীতির বাইরে কোনো একটি বিকল্প ধারার আকাঙ্ক্ষাকে অনুভব করেন। সৃষ্টি হয় আম আদমি পার্টি, যেখানে সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা যোগদান করেন এবং দলটি দ্রুত জনপ্রিয়তা পায়। তারা দিল্লি অঞ্চলে সরকারও গঠন করেন। যদিও তারা প্রচলিত কাঠামোর মাঝে নতুন ধারার রাজনীতি পরিচালনার সমস্যাগুলো দ্রুতই টের পান। যাই হোক, এএপির অভিজ্ঞতাটি হলো সুশীল সমাজ থেকে রাজনৈতিক সমাজে পরিণত হওয়ার একটি ধ্রুপদী উদাহরণ। বাংলাদেশে কেউই এ ধরনের চ্যালেঞ্জ সফলভাবে নিতে পারবে কিনা তা সময়ই বলে দেবে। (চলবে)
(ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের উদ্যোগে আয়োজিত শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক বক্তৃতা হিসেবে পঠিত)
লেখক: সম্মানীয় ফেলো
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)