নীলফামারীতে ইটভাটা গিলে খাচ্ছে আবাদি জমি, হুমকির মুখে পরিবেশ
নীলফমারী প্রতিনিধি, মো. শাইখুল ইসলাম সাগর, ১৭ এপ্রিল, ২০২১ (বিডি ক্রাইম নিউজ ২৪) : আইন ও নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নীলফামারী সদর, ডোমার, ডিমলা, কিশোরগঞ্জ, সৈয়দপুর ও জলঢাকা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ধান ক্ষেতে ইটভাটা গড়ে উঠায় গিলে খাচ্ছে আবাদি জমি, হুমকির মুখে পরিবেশ। স্থানীয় প্রশাসন কৃষি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের চোখের সামনে ইটভাটা মালিকরা অবৈধভাবে ইটভাটা নির্মান করছেন এমন অভিযোগ করছেন কৃষকেরা। ইটভাটার মালিকরা নিয়মনীতির কোন তোয়াক্কা করছে না, এতে হুমকীতে পড়েছে ফসলি জমি। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫, পরিবেশ বিধিমালা- ১৯৯৭, ইটপোড়ানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০০১ এবং শব্দ দূষণ বিধিমালা-২০০৬ আইন থাকলেও অবৈধ ইটভাটার মালিকরা তা মানছে না।
নীলফামারী সদর উপজেলার গোড়গ্রাম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রেয়াজুল ইসলাম জানান, তার ইউনিয়নে ৬টি ভাটা রয়েছে। ভাটার কারণে এলাকার পরিবেশই শুধু নয় নীলফামারী- দেবীগঞ্জ সড়কের বেহাল দশা, ক্যালেন দখল এবং গোটা সড়ক ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। এ ছাড়া পিকনিক স্পট নীলসাগরের আধা কিলোমিটার দুরে মেসার্স সাজারাত ব্রিক্স ফিল্ড (এসবিএফ) সরকারি তালিকায় নাম নেই, উত্তর মাছপাড়া গ্রামে টিএবি ব্রিকস-১ ও হাজীগঞ্জ বাজারের কাছে টিএবি নামে আরো একটি ভাটা রয়েছে (যদিও সরকারি তালিকায় এটির নাম নেই), ডোমারের শালকি ব্রিকস, এসএমবি ব্রিকস জলঢাকার এইচএন্ডএস, এমএইচবি ব্রিকস, আরএমবি ব্রিকস, এসবিএল ব্রিকস, একে ব্রিকস, কিশোরগঞ্জ আরবিএফ ব্রিকস, আরেফিন ব্রিকস, সৈয়দপুর এমএএস ব্রিকস, এসকে ব্রিকস, এমজেডএইচ ব্রিকস, এমবিএস ব্রিকস, বিপিএল ব্রিকস, ইউবিএল ব্রিকস, বিবি ব্রিকস, এমবিসি ব্রিকস, সোনার বাংলা ব্রিকস, এনআরবি ব্রিকস সহ জেলার অধিকাংশ ইটভাটায় পরিবেশ অধিদপ্তর, কৃষি অফিসের ছাড়পত্র ও জেলা প্রশাসনের লাইসেন্স ছাড়া ঝিকঝ্যাঁক, ড্রাম চিমনী (ব্যারেল) ও কাচা ইট পোড়ানোর কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে।
স্বল্প উচ্চতার ড্রাম চিমনি ১২০ ফুট উচ্চতার স্থায়ী চিমনীর ইটভাটা স্থাপন করা হয়েছে। জ্বালানী হিসাবে অনেক ইটভাটায় কয়লার পরিবর্তে কাঠ ব্যবহারের জন্য গ্রাম থেকে বিভিন্ন জাতের গাছ কেটে এনে ভাটায় পোড়াচ্ছে। এত পরিবেশ বিপর্যয়সহ জনস্বাস্থেও মারাত্মক হুমকীর আশংকা করেছে পরিবেশবাদীরা। কৃষি জমিতে ইটভাটা নির্মান করায় ফসল নষ্ট হচ্ছে। দিন দিন কমে যাচ্ছে ফসলি জমি। ২০১৪ সালের ১লা জুলাই থেকে কার্যকর হওয়া ইট প্রস্তত ও ভাটা স্থাপন সংশোধিত আইনের ৮(১) অনুযায়ী লোকালয়, আবাসিক ও পৌরসভা এলাকায় এবং কৃষি জমিতে ইট ভাটা স্থাপন ও ইট পোড়ানো আইনগত নিষিদ্ধ। একই আইনের ৫ ধারায় ইট প্রস্তত কাজে কৃষি জমির উপরিভাগ এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত ব্যতিত পুকুর, খাল, বিল, দিঘী, ধাঁড়ি ও নদী থেকে মাটি কেটে ইটভাটায় ব্যবহার করাও দন্ডনীয় অপরাধ। এছাড়া স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর কর্তৃক নির্মিত উপজেলা ইউনিয়ন বা গ্রামীন সড়ক ও এল জি ই ডি রাস্তা থেকে কমপক্ষে ১ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে ইটভাটা স্থাপন করার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। প্রায়ই ইটভাটা গুলি রাস্তা সংলগ্ন স্থাপন করেছেন। আইন অনুযায়ী আবাদি জমিতে বা ভাটার তিন কিলোমিটারের মধ্যে বা বাগান থাকলে ভাটা স্থাপনের কোন নিয়ম নেই। লোকালয় থেকে তিন কিলোমিটার দুরে যেখানে জনবসতি নেই এমন জায়গায় ইট ভাটা নির্মাণ করতে হবে কিন্তু নীলফামারীতে কৃষি জমি দখল করেই প্রতি বছর গড়ে তোলা হচ্ছে নতুন নতুন ইটভাটা। একই সাথে ইটভাটার জন্য সর্বোচ্চ দুই একর জমি ব্যবহারের নিয়ম থাকলেও অধিকাংশ ইটভাটায় এ নিয়ম মানা হচ্ছে না।
এ ছাড়াও প্রতিদিন শ’ শ’ অবৈধ ট্রলি ও ট্রাক্টরে অতিরিক্ত ইট ও মাটি পরিবহনের ফলে ভেঙে চৌচির হচ্ছে এলাকার কাঁচা-পাকা রাস্তাঘাট। কিন্তু দেখার বা বলার যেন কেউ নেই। কুলী পাকানো কার্বন-ডাই-অক্সাইড মিশ্রিত কালো ধোঁয়া পরিবেশের মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইটভাটার ঝাঁঝালো ধোঁয়ায় ঢেকে যাচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম জনপদ। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশ। বিনষ্ট হচ্ছে জমির ফসল।
জেলা কৃষিসম্প্রসারন অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, কৃষি জমিতে ইটভাটা নির্মানের জন্য আমরা কোন ছাড়পত্র দেইনী। যদি কেউ করে থাকে তাহলে অবৈধ ভাবে করেছে। কৃষি জমিতে ইটভাটা করলে ফসলি জমি নষ্ট হয়ে থাকে এবং ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হয়ে থাকে। কোন ইটভাটার আমি প্রত্যায়ন দেইনি। ইটভাটাগুলি প্রত্যায়ন ছাড়াই তৈরী করেছে।
রংপুর বিভাগের পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ইটভাটা নির্মান করতে হলে পরিবেশের ছাড়পত্র লাগবে। পরিবেশের ছাড়পত্র ছাড়া ইটভাটা নির্মান করতে পারবেনা। কিন্তু অনেক ইটভাটা মালিকেরা আইন অমান্য করে অবৈধভাবে ইটভাটা নির্মান করেছে। যা পরিবেশ মারাত্মক হুমকীর মুখে পড়ছে।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক হাফিজুর রহমান চৌধুরীর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ইটভাটা গুলিতে পরিবেশের ছাড়পত্র ও কৃষি প্রত্যয়ন না থাকলে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে আইনানুগ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।