চলেই গেলেন সাবেক মন্ত্রী মামদুদুুর- এম নজরুল ইসলাম
বগুড়া প্রতিনিধি, এম নজরুল ইসলাম, ০৭ এপ্রিল, ২০১৮ (বিডি ক্রাইম নিউজ ২৪) : একটি মৃত্যু সংবাদে ঘুম থেকে জেগে ওঠা সকালে একটি শহর কেঁদে উঠল। দিনের সকল কর্মকান্ড এলোমেলো হয়ে গেলো। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে বাতাসে খবর ছড়াতে থাকল। একদম আকস্মিক বিনা নোটিশে অকালে চলে গেলেন স্বপ্নবাজ সুনাগরিক।
কীর্তিমানের মৃত্যু নেই, এই প্রবাদ আমরা জানি। তবুও যিনি চলে যান তাঁর রেখে যাওয়া স্বপ্ন আর তাঁর স্পর্শ করা সময়ের স্মৃতি আমাদেরকে নাড়িয়ে যায়। এমনই এক স্বপ্নবাজ সুনাগরিক রাজধানী উন্নয়নের অনন্য রূপকার ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আনিসুল হককে হারানোর পর আরেক স্বপ্নবাজ সুনাগরিক হারালো বাংলাদেশ।
তিনি সাবেক মন্ত্রী বগুড়ার মামদুদুর রহমান চৌধুরী। শুধুই সুনাগরিক যে ছিলেন তিনি, তাই নয়, তিনি বগুড়ার মানুষের আত্মীয়। উন্নয়নের অনন্য রূপকার। বগুড়ার বনেদি সাতানী পরিবারের সন্তান বিশিষ্ট রাজনীতিক, সাবেক মন্ত্রী ও বগুড়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক সকালের আনন্দ পত্রিকার সম্পাদক মামদুদুর রহমান চৌধুরী বুধবার (৪ এপ্রিল) সকালে ঢাকার একটি ক্লিনিকে ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি……রাজিউন)।
তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। তিনি স্ত্রী, ১ মেয়ে ও ২ ছেলেসহ অনেক গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তার ছোট বোন ইসমাত আরা সাদিক বর্তমান সরকারের জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী। মামদুদুর রহমান চৌধুরী বার্ধক্যজনিত কারণে নানা রোগে আক্রান্ত ছিলেন। তার পূর্বপুরুষ বগুড়ার সাত আনা অংশের জমিদার ছিলেন। তাদের সম্পত্তির বড় অংশ বগুড়ার পূর্বাংশের কাহালু এলাকায়। নগরীতে তাদের বাড়ির নাম সাতানী হাউস।
সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে তিনি জাতীয় পার্টিতে যোগদান করেন। ওই সময়ের নির্বাচনে তিনি ৩৯ বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হন। এরপর তিনি প্রথমে এরশাদ সরকারের যোগাযোগ উপমন্ত্রী ও পরে নৌপরিবহন মন্ত্রী নিযুক্ত হন।
এরশাদ সরকারের ক্ষমতা হস্তান্তরের পর তিনি বেশ কিছুদিন রাজনীতি থেকে দূরে থাকেন। বিএনপি সরকারের প্রথম দফায় তিনি বিএনপিতে যোগদান করেন। তারপর তিনি এলডিপিতে যোগদান করেন। সর্বশেষ তিনি নিজে বাংলাদেশ জনতা পার্টি নামে একটি দল গঠন করে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেন। এখনও তার দল নিবন্ধন পায়নি।
এরশাদের শাসনামলে তিনি বগুড়া-৪ আসনে ব্যাপক উন্নয়নের বিপ্লব ঘটান। যেকারণে মামদুদুর রহমান চৌধুরী ছিলেন জনপ্রিয়। জনগণের সাথে আত্মীয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বিনা টাকায় বিভিন্ন স্কুল-কলেজসহ সরকারি চাকরি পেয়েছেন অনেক মানুষ।
মামদুদুর রহমান চৌধুরীর ঘনিষ্ট ছিলেন জেলার নন্দীগ্রাম উপজেলার রণবাঘার সাংবাদিক নাজির হোসেন, শালিকাপাড়ার শাজাহান, বটব্রিক’র মরহুম আব্দুল কাদের এবং কাহালু উপজেলার ইব্রাহিম আলী ধলু ও হেলালুদ্দিনসহ আরো অনেকে। এরমধ্যে না ফেরার দেশের চলে গেছেন নাম না জানা অনেকেই। এলাকার উন্নয়নসহ জনগণের কল্যাণে কাজ করেছেন স্বপ্নবাজ সুনাগরিকবৃন্দ।
সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না আর জন্ম-মৃত্যুর মাঝেই মানুষের জীবন। পৃথিবীতে মানুষ বেঁচে থাকার জন্য কত রকমের স্বপ্ন দেখে থাকে। কারো স্বপ্ন পূরণ হয়, আবার কারো স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। তাকে চলে যেতে হয় আপন ঠিকানায়। রেখে যায় স্মৃতি। কিছু কথা। আপনজনেরা সেই স্মৃতি কথা নিয়ে বেঁচে থাকে।
এছাড়া যে আর কোন উপায়ই নেই। এটাই তো জীবন। জীবনের অবশ্যম্ভাবী পরিনতির নাম মৃত্যু। মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী হলেও কিছু কিছু মৃত্যু মানুষের হৃদয়কে বার বার দোলা দিয়ে যায়। তাদেরই একজন হচ্ছেন বহুবিধ প্রতিভার অধিকারী সাবেক মন্ত্রী মামদুদুর রহমান চৌধুরী।
এই সুনাগরিক স্বপ্ন সাজাতেন দুখি মানুষকে নিয়ে। উন্নয়নপ্রিয় মানুষটি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। তিনি আর কখনো ফিরবেন না। তবে তিনি তাঁর কর্মে মানুষের প্রাণে প্রাণে থাকবেন। আত্মীয়ের মতোই সম্পর্ক ছিল সকলের সাথে। খুব প্রাণবন্ত ব্যবহার ছিল। এই ক্ষতির কোনো পরিমাপ হয় না। অনেক স্মৃতি, অনেক আদরের কথা মনে পড়ছে।
তিনি সবার কথা ভাবতেন। অনেক বড় মনের মানুষ ছিলেন। যা রেখে গেলেন, যা শিখিয়েছেন, তার একটুও করতে পারলে খুশি হব- কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন মামদুদুর রহমান চৌধুরীর ঘনিষ্ট নন্দীগ্রাম উপজেলার রণবাঘার সাংবাদিক নাজির হোসেন।
প্রকৃতির নির্মম সত্য যে মৃত্যু, সেই মৃত্যুর কাছে তাকে চলে যেতেই হলো। সফল সংগঠক হিসেবে বরাবরই সমাদৃত ও প্রশংসিত ছিলেন সাবেক মন্ত্রী মামদুদ।
নাজির হোসেন বলেন, এমন প্রলম্বিত মৃত্যু সবার হৃদয়ের গভীরে যে দাগ কেটেছে, তা কখনোই ভুলবার নয়। তাঁর শূন্যতা পূরণ করা কঠিন হবে। সৃষ্টিশীল গুণ ছিল তাঁর মধ্যে। আমি তাঁকে লম্বা সময় ধরে চিনি। তিনি ছিলেন অদ্বিতীয় একজন, কঠোর পরিশ্রমী, নিবেদিতপ্রাণ ও সত্যিকার অর্থেই জনগণের একজন।
তাঁর অবদান অনেক। উনি আমাদের ডেকে নানা বিষয়ে পরামর্শ করতেন। উন্নয়ন নিয়ে ভাবতেন। আমাদের পরিকল্পনাকে তিনি সবসময় গুরুত্ব দিতেন। তাঁর কর্মের জন্য বগুড়ার মানুষ তাঁকে মনে রাখবে।
তার কর্ম, জীবন এবং জীবনাচার ও স্বপ্ন দেখা এবং তা বাস্তবায়নের যে পথনির্দেশিকা রেখে গেলেন- তা থেকে রাজনীতিবিদ, সমাজ সংস্কারক, মানবতাবাদি, উন্নয়নকর্মী নির্বিশেষে সবার শিক্ষণীয় এবং অনুকরণ করার আছে অনেক কিছু। তিনি জীবন এবং কর্মকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন বলেই জীবনের প্রতিটি স্তরে, প্রতিটি কাজে এসেছে সফলতা।
হাজারো ভক্ত, অনুরাগী ও শুভাকাঙ্খী রেখে মামদুদুর রহমান চৌধুরী চলে গেলেন না ফেরার দেশে। রাজনৈতিকসহ সকল অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তার মতো অভিজ্ঞ, সৎ ও নিষ্ঠাবান নেতা বিরল। রাজনীতি ও সামাজিক অগ্রগতির পক্ষে তিনি ছিলেন বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর।
একটি শক্তিশালী বৃক্ষের এভাবে ঝরে পড়া অরেক দফা রাজনৈতিক নেতৃতের শূন্যতা সৃষ্টি করল। যাই হোক মৃত্যুর উপরে তো কারো হাত নেই। আল্লাহর কাছে দোয়া করি।
এম নজরুল ইসলাম
লেখক : সাংবাদিক ও সংগঠক।
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, মানব কল্যাণে জাতীয় সাংবাদিক ফাউন্ডেশন, কেন্দ্রীয় কমিটি।