‘স্বপ্নের পদ্মা সেতু’ দৃশ্যমান হলো ৬.১৫ কিলোমিটার

মুন্সীগঞ্জ, ১০ ডিসেম্বর ,২০২০ (বিডি ক্রাইম নিউজ ২৪) : স্বপ্নের পদ্মা সেতু পুরোপুরি দৃশ্যমান হয়েছে। সর্বশেষ ৪১ তম স্প্যান স্থাপনের মধ্য দিয়ে পুরো সেতুটির ৬.১৫ কিলোমিটার দৃশ্যমান হলো। পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী (মূলসেতু) দেওয়ান মোঃ আবদুল কাদের জানিয়েছেন, আজ দুপুরে ১২টা ২ মিনিটে সর্বশেষ ৪১তম স্প্যানটি সেতুর ১২ ও ১৩ নম্বর খুটির উপর বসানো হয়। এর মধ্য দিয়ে পদ্মার দুই পাড় মাওয়া ও জাজিরা যুক্ত হয়ে গেলো এবং এর পর সড়ক ও রেলের স্ল্যাব বসানো সম্পন্ন হলে যানবাহন ও ট্রেন চলাচল করতে পারবে। এর আগে বুধবার পদ্মা সেতুর এই শেষ স্প্যান ‘২-এফ’ ইয়ার্ড থেকে ভাসমান ক্রেনবাহী জাহাজ ‘তিয়ান ই’ তুলে নিয়ে ১২ ও ১৩ নম্বর খুঁটির উদ্দেশ্যে রওয়ানা করে।

পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক সফিকুল ইসলাম জানান, সকাল ৯টায় ইঞ্চি ইঞ্চি মেপে পজিশনিং করে মাওয়া প্রান্তের ১২ ও ১৩ নম্বর খুঁটির ওপর ২-এফ নম্বর স্প্যানটি স্থাপনের কাজ শুরু হয় এবং ১২টার দিকে স্থাপন কাজ শেষ হয়। নৌ পরিবহনমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, বিআইডব্লিউটিএ এর চেয়ারম্যান কমোডোর গোলাম সাদেক, বিআই ডব্ল্উিটিসির চেয়ারম্যান সৈয়দ তাজুল ইসলাম সহ পদ্মা সেতুর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তরা এসময় উপস্থিত ছিলেন। এদিকে পদ্মা সেতুর পুরো দৃশ্যমানের মাহেন্দ্রক্ষণ ঘিরে উপস্থিত দর্শনার্থীদের ও মধ্যে বিশেষ উৎসব আমেজ বিরাজ করছে। ইতিহাসের অংশ হওয়ার জন্য অনেকেই আসছেন পদ্মায়। পদ্মার দু’পাড়ের এ সেতু বন্ধনকে ঘিরে পদ্মা পাড়ের মানুষগুলো আনন্দে উদ্বেলিত।

বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের মধ্যে ভালো লাগা কাজ করছে। কারণ এই সেতু চালু হলে এই অঞ্চলের মানুষসহ গোটা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুগান্তকারী অধ্যায় রচিত হবে। জাতীয় অর্থনীতির চাকায় গতি বাড়বে। ৪১তম স্প্যানটি স্থাপনের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে বুধবার বিকাল ঠিক ৫টা ৫ মিনিটে ৩২শ’ টন ওজনের ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের এই স্প্যানটি মাওয়া কুমারভোগের কন্সট্রাকশন ইয়ার্ডে থেকে নিয়ে খুঁটির উদ্দেশ্যে রওনা দেয় ভাসমান জাহাজ ‘তিয়ান-ই’। ৫টা ৪৫ মিনিটে জাহাজটি ১২ ও ১৩ নম্বর খুঁটির কাছে পৌঁছে নোঙর করে।

পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী (মূলসেতু) দেওয়ান মোঃ আব্দুর কাদের বলেন, এর আগে ৪১টি স্প্যানের মধ্যে জাজিরা প্রান্তে ২০টি স্প্যান বসানো হয়েছে, আর মাওয়া প্রান্তে বসানো হয়েছে ১৯টি স্প্যান। একটি স্প্যান বসেছে মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তের মাঝখানে। আর সর্বশেষ স্প্যানটি আজ বসানো হয় মাওয়া প্রান্তে। করোনাক্রান্ত স্থানীয় সংসদ সদস্য (মুন্সীগঞ্জ-২) সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি বলেছেন, এই সেতু নির্মাণ বাঙালি জাতির সক্ষমতাকে বিশ্বে নতুন করে জানান দিলো। এর মূলেই রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রজ্ঞাপূর্ণ সিদ্ধান্ত। এই সেতু বাস্তাবায়নের জন্য যাদের ত্যাগ, শ্রম, ঘাম রয়েছে তাদের প্রত্যেকের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন দু’পাড়ের সেতু বন্ধন প্রাচীন বিক্রমপুরকে আবার একই বন্ধনে যুক্ত করলো। এই সেতুর সুফল ভোগ করবে পুরো জাতি।

২০১৪ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটিতে প্রথম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হতে শুরু করে পদ্মা সেতু। এর পর একে একে বসানো হয় ৪০টি স্প্যান। এতে দৃশ্যমান হয়েছে সেতুর ৬ কিলোমিটার। ৪২টি পিলারে ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের ৪১টি স্প্যান বসিয়ে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু তৈরি হচ্ছে। মূলসেতু নির্মাণের জন্য কাজ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি) ও নদী শাসনের কাজ করছে দেশটির আরেকটি প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো করপোরেশন। দু’টি সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণ করেছে বাংলাদেশের আবদুল মোমেন লিমিটেড। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ২২ মিটার প্রসস্ত এ বহুমুখী সেতুর মূল আকৃতি হবে দোতলা। কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মিত হচ্ছে এ সেতুর কাঠামো। পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার পর আগামী ২০২১ সালের ডিসেম্বরে খুলে দেয়া হবে যান চলাচলের জন্য।

এদিকে শেষ স্প্যান বসানোকে কেন্দ্র করে পদ্মা সেতু এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। পদ্মা সেতু এলাকার নিরাপত্তার দায়িত্বে আছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৯৯ কম্পোজিট ব্রিগ্রেড। সেতুর প্রকল্প ব্যবস্থাপক ও নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান মো. আব্দুল কাদের জানান, বুধবার ও বৃহস্পতিবার সেতুর নিরাপত্তা আরও জোরদার করা হয়। আজ পদ্মা সেতুর সবক’টি স্প্যান বসানো শেষ হওয়ায় দৃশ্যমান হলো সেতুর পুরো ৬.১৫ কিলোমিটার। তবে, এরপরও সেতুর আরো অনেক কাজ বাকী থাকবে যা সম্পূর্ণ শেষ হতে প্রায় এক বছর লাগবে। এমনটাই জানিয়েছেন প্রকল্প ব্যবস্থাপক ও নির্বাহী প্রকৌশলী (মূল সেতু) দেওয়ান মো. আব্দুল কাদের।

তিনি জানান, ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত মূল সেতুর ২৯১৭টি রোডওয়ে স্ল্যাব এর মধ্যে ১২৮৫টি এবং ২৯৫৯টি রেলওয়ে স্ল্যাব এর মধ্যে ১৯৩০টি স্থাপন করা হয়েছে। মাওয়া ও জাজিরা ভায়াডাক্টে ৪৮৪টি সুপার-টি গার্ডারের মধ্যে ৩১০টি স্থাপন করা হয়েছে। বাকী রোডওয়ে স্ল্যাব, রেলওয়ে স্ল্যাব ও সুপার-টি গার্ডার বসাতে প্রায় আটমাস সময় লাগবে। এর পরে শ্ল্যাবের উপর পিচ ঢালাইয়ের কাজ করতে হবে। এছাড়া, ল্যাম্পপোস্ট বসানোর কাজও বাকী। নদী ভাঙনের কবলে পদ্মা সেতুর ১২৬টি রোডওয়ে শ্ল্যাব ও ১৯২টি রেলওয়ে শ্ল্যাব নদীতে বিলীন হয়। সেগুলো নতুন করে তৈরি করা হচ্ছে। রেলওয়ে গার্ডার লুক্সেমবার্গ থেকে আনা হবে। আগামী ফেব্রুয়ারি মাস নাগাদ সেগুলো কন্সট্রাকশন সাইটে পৌঁছে যাওয়ার কথা।

এসকল কাজ ছাড়াও বিদ্যুত, গ্যাস ও টেলিযোগাযোগ লাইন স্থাপনের কাজ বাকী আছে। সব মিলিয়ে বছর খানেক পর যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হতে পারে পদ্মা সেতু। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, গত ৩ ডিসেম্বর, ২০২০ পর্যন্ত মূল সেতুর বাস্তব কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৯১ ভাগ। এদিকে, পদ্মা সেতুর নদী শাসন কাজের বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ৭৫ দশমিক ৫০ ভাগ। সেতুতে বিশ্বের দীর্ঘতম ১২২ মিটার পাইল স্থাপন, ১৫ টন ওজনের ৯৮৭২৫ কিলো নিউটন ক্ষমতা সম্পন্ন ফিকশন প্যান্ডিলাম বেয়ারিং ব্যবহার ও নদী শাসনের সর্বোচ্চ ১.১ বিলিয়ন (প্রায় ৮ হাজার ৮শ’ কোটি) টাকা টাকার চুক্তি এইসব বিশ্ব রেকর্ড। এছাড়াও কোন নির্মাণ কাজে বিশ্বে প্রথম ব্যবহার করা হয়েছে ভার্টিক্যাল আরসিসি বোর্ড পাইলে গ্রাউটিং ইনজেক্ট স্কিন ফিকশন করে দৃঢ়তা বৃদ্ধি করে নদীর তলদেশে বর্হিভাবে শক্তি বৃদ্ধি। পদ্মায় এমন পাইল সংখ্যা ২২টি। অপরটি স্টিল টিউবুলার ড্রিভেন পাইলে গ্রাউটিং ইনজেক্ট করে পাইলের তলদেশের স্কিন ফিকশন সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। এমন পাইল সংখ্যা ২৫২টি।

পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ রজব আলী জানান, সেতুতে ১৫টন ওজনের ৯৮৭২৫ কিলো নিউটন ক্ষমতা সম্পন্ন ফিকশন প্যান্ডিলাম বেয়ারিং ব্যবহার করা হচ্ছে। যা উচ্চ মাত্রার ভূমিকম্প প্রতিরোধক। পুরো সেতুতে ৫ ধরণের ৯৬টি বেয়ারিং ব্যবহার করা হচ্ছে। যার মধ্যে ৩৫টি স্প্যানের সাথে ২টি করে বেয়ারিং ব্যবহার করা হচ্ছে। আর সেতুর এক্সপানশন জয়েন্টে ৪টি করে বেয়ারিং ব্যবহার হচ্ছে। ৬.১৫ কিলোমিটার সেতুতে মোট ৭টি জয়েন্ট থাকছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে নদী শাসনে চায়না সিনোহাইড্রো কর্পোরেশনের সাথে সর্বোচ্চ প্রায় ৮ হাজার ৮শ’ কোটি টাকার চুক্তি হয়। এটিও বিশ্ব রেকর্ড। নদী শাসনে এখনও পর্যন্ত এত বড় চুক্তি আর কোথাও হয়নি। পদ্মা সেতুর পাইলে ১ লাখ ৪৬ হাজার মেট্রিক টন স্টিল ব্যবহার করা হয়েছে। সবমোর্ট ২৬৬ পাইল । আর পদ্মা সেতুর ৪১টি স্প্যানের ওজন ১ লাখ ১৬ হাজার ৩৮৮ মেট্রিক টন। প্রতিটি স্প্যানের সর্বোচ্চ ওজন ৩০ হাজার ৮৮ মে. টন।

পদ্মা সেতুর প্রতিটি পাইলের সক্ষমতা ১২৪.৬০ মেগা নিউটন। অর্থ্যাৎ প্রায় ৮ হাজার ৭শ’ মেট্রিক টন। পদ্মা সেতুর দুই প্রান্তে রয়েছে ১২.১২ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক। পদ্মা সেতুতে ২৯৬০টি রেলওয়ে স্লাব এবং ২৯১৭টি রোডওয়ে স্লাব স্থাপন হচ্ছে। ইউরোপের লুকজেম্বার থেকে আনা রেলওয়ে স্ট্যানজার স্থাপন হচ্ছে প্রতিটি স্প্যানে চারটি করে। সেতুতে সাধারণ আলোর ব্যবস্থা ছাড়াও আর্কিটেকচার লাইটিংও থাকছে। বিশেষ বিশেষ দিবস গুলোতে এবং বিশেষ সময়ে লাইটিংয়ের মাধ্যমে সৌন্দর্যবর্ধণ করা হবে। পদ্মা সেতুর ন্যাশনাল গ্রিডিংয়ের জন্য সেতুর ৫শ’ মিটার ভাটিতে পদ্মায় ৮টি বৈদ্যুতিক টাওয়ারের পাইল স্থাপন করা হয়েছে এই প্রকল্পের আওতায়। ৬.১৫ কিলোমিটার মূল সেতুর সাথে ৩.৬৮ কিলোমিটার সংযোগ সেতুসহ পদ্মা সেতু হচ্ছে ৯.৮৩ কিলোমিটার। সংযোগ সেতুর মাওয়া প্রান্তে ১.৪৭ কিলোমিটার এবং জাজিরা প্রান্তে ১.৬৭ কিলোমিটার। আর মূল সেতুর সাথে দুই প্রান্তে রেল সংযোগ সেতু রয়েছে কিলোমিটার। পদ্মা সেতেুতে সিসি ক্যামেরা থাকছে। সেতু চালুর প্রথমেই প্রতিদিন ১২ হাজার যান পারাপার হবে। ২০৩০ সালে পদ্মা সেতু দিয়ে প্রতিদিন ৩০ হাজার গাড়ি চলাচলের টার্গেট রয়েছে। শুরুর দিকে প্রতিদিন টোল আদায়ে হবে আয় প্রায় আড়াই কোটি । আর অতিরিক্ত মাল পরিবহন ঠেকাতে সেতুর দুই প্রান্তে দুই পাড়েই ওয়ে ব্রিজ বসানো হচ্ছে।

সেতুর দু’পাড়ে সংযোগ সড়কের মধ্যে জাজিরা প্রান্তে সাড়ে ১০ কিলোমিটার এবং মাওয়া প্রান্তে ১.৬৭ কিলোমিটার। এটি উদ্বোধন হয় ২০১৭ সালে ৮ জানুয়ারি। পদ্মা সেতুর প্রকল্পের পুনর্বাসনে জন্য ২৯০৬ প্লট করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৮৫৫টি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। প্লটের রেজিস্টশন শুরু হয়েছে ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে। এ পর্যন্ত ১৩৬টি রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হয়েছে। প্রাণী জাদুঘরে ২২৮১টি প্রাণীকূলের নমুমা সংগ্রহ হয়েছে। পদ্মা সেতুর সার্ভিস এরিয়ায়-১ এই জাদুঘর। এখানে ব্রিজ মিউজিয়ামও হচ্ছে। সেতুতে যে সকল উপকরণ, বেয়ারিং, গার্ডারসহ যেসব কিছু ব্যবহার হয়েছে পার্টে পার্টে এর নমুনা থাকছে এই জাদুঘরে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *