নরসিংদীর মনোহরদীতে হাতিরদিয়া দিবস উদযাপিত

নরসিংদী প্রতিনিধি, কে.এইচ.নজরুল ইসলাম, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২০ (বিডি ক্রাইম নিউজ ২৪) : নরসিংদীর মনোহরদীতে হাতিরদিয়া দিবস পালিত হয়েছে। হাতিরদিয়া বাজারে শহীদ মিনারে  মঙ্গলবার ২৯ ডিসেম্বর সকালে ৩ শহীদের সরণে পুস্পস্তবক অর্পণ করা হয়। পুস্পস্তবক অর্পণ করেন, শামসুজ্জামান মিলন সাধারণ সম্পাদক  শহীদ আসাদ পরিষদ, তোফাজ্জল হোসেন মাস্টার সাধারণ সম্পাদক নরসিংদী জেলা বিএনপি, সুদীৎ শার্মা সহকারী অধ্যহ্ম যোগাযোগও সাংবাদিক বিভাগ চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, নাজমুল আলম সোহাগ আহবায়ক জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল নরসিংদী জেলা শাখা, মোবারক হোসেন আহবায়ক  (বাসদ) জেলা  শাখা, হাবিবুল্লাহ বাহার শিহ্মক হাতিরদিয়া শাহাব উদ্দীন মেমোরিয়াল একাডেমী, সুমন আজাদ জেলা আহবায়ক গনতান্ত্রীক বিপ্লব কমিটিসহ সামাজিক সংগঠন পুস্পস্তবক অর্পণ করেন।

পুস্পস্তবক অর্পণ শেষে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। হাতিরদিয়া দিবস উদযাপন কমিটির  আহবায়ক  কবি পায়েল কার্য`এর সভাপতিত্বে সভায়  উপস্থিত ছিলেন, শামসুজ্জামান মিলন সাধারণ সম্পাদক শহীদ আসাদ পরিষদ, সুদীৎ শার্মা সহকারী অধ্যহ্ম যোগাযোগও সাংবাদিক বিভাগ চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, এমএ হাসান জেলা সদস্য সচিব (বাসদ), নাজমুল আলম সোহাগ, সুমন ইসুফ, মোবারক হোসেন, আবুল কাশেম, হাবিবুল্লাহ বাহার, কারীমা পুস্পীতা প্রমুখ।

উলেখ্যঃ ১৯৬৯ এর গণ-অভ্যূহুান রাতারাতি সংঘটিত হয়নি। অসংখ্য আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এর পেহ্মাপট তৈরি হয়েছে। ১৯৬৮ সানের শেষ ভাগে  আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মাধ্যমে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগ প্রধান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ প্রায় সকল নেতাদেরকে কারাগারে অন্তরীন করা হয়। ওই সময় ন্যাশনাল আওয়ামী পাটি (ন্যাপ;র প্রতিষ্ঠাতা) প্রধান উপ-মহাদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবীদ  মরহুম মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ডিসেম্বরের শেষ দিকে এসে তিনি তৎকালীন পাকিস্তানের স্বৈরোশাসক কোর্টমার্শাল আয়ূব খান বিরোধী অন্দোনের কঠোর কর্মসূচীর  ডাক দেয়।

৬  ডিসেম্বর ঢাকার পল্টন ময়দানের ঐতিহাসিক জনসভায় আন্দোলনের কঠোর কর্মসূচির ঘোষণার প্রেক্ষীতে ২৯ ডিসেম্বর মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানি পূর্ব পাকিস্তানের সকল শহর বন্দর-গ্রাম-গঞ্জ, হাট-বাজার সহ সর্বত্র  হরতালের আহবান করেন। এরই ধারাবাহিগতায় ২৯ ডিসেম্বর হরতাল সফলও স্বার্থক করতে নরসিংদীর মনোহরদী থানার ঐতিহ্যবাহী হাতিরদিয়া বাজারে ২৮ ডিসেম্বর শনিবার বিকেলে পূর্ব বাংলার ছাত্র ইউনিয়নের ছাত্র নেতা শহীদ আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান আসাদের নেতৃত্বে শিবপুর থানা থেকে ২০-৩০ জনের ছাত্র, কৃষক জনতা  ঐতিহ্যবাহী হাতিরদিয়া বাজারে পৌঁছেন।

বাজারের পুরনো সমিতি ঘরে বসে আগামীকালের দেশ ব্যাপী হরতাল সফল করার লহ্মে পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। হাতিরদিয়া বাজারের রাস্তার মোড়ে মোড়ে  হরতালের সমর্থনে পথ সভা করেন। ঢোল-বোমা দিয়ে হরতালের খবর জানায় এবং সহকর্মীদের সাথে নিয়ে রাতাব্যাপী পোস্টার লিখে সারা বাজার পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে ফেলে। হাতিরদিয়া বাজার ছিল এ অঞ্চলের সবাপেক্ষা  বড় বাজার। ১৯৬৮ সালের রবিবার ২৯ ডিসেম্বর সকাল ১১ টায় ঢাকা বিশ্বদ্যালয়ের ছাত্র নেতা শহীদ আসাদের নেতৃত্বে ছাত্র জনতা, কৃষক মিলে  পিকিটিংয়ে নামেন ।

এই দিন দুপুর ১২ টায়  পিকিটংয়ের এক পর্যায়ে পাকিস্তানি পুলিশ  গোয়েন্দা বাহিনী তাদের উপর  নজর শুরু করেন। বেলা ২ টার দিকে পুলিশ হঠাৎ মারমুখী হয়ে ওঠে পুলিশ। এক পর্যায়ে  পিকেটিংয়ে অংশগ্রহনকারী নেতা কর্মীদেরকে বেধরক লাঠিচার্জ ও ধরপাকড় শুরু করে।তখন গ্রেফতার হয়  ৫ জন।পুলিশ মনোহরদীর হাতিরদিয়ার মরহুম সাবেক অধ্যহ্ম তোফাজ্জল হোসেন ভূইয়া শাহজাহান, শিবপুরের তোফাজ্জল হোসেন মাস্টার, বদরুজ্জামান সেন্টু মোল্লা (ধানুয়া) এবং মাইক মালিক আব্দুল হাই গড়বাড়ির ও শহীদ আাসাদুজ্জামান আসাদসহ  ৫ জনকে গ্রেফতার করে। শহীদ আসাদ পুলিশের সাথে ধ্বস্তাধস্তি করে মাথায় রাইফেলের বাটের আঘাত পেয়েও সার্টের বোতাম ছিঁড়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়।

এর পর পুলিশ গরু বাজারে অবস্থিত স্থানীয় রমিজ উদ্দিন ব্যাপারীর পাটের গুদামে আটক করে রাখেন। গ্রেফতারের সংবাদ পেয়ে ছাত্র-কৃষক জনতা হ্মুদ্ধ হয়ে উঠে। পাটের গুদাম থেকে ৪ জনকে উদ্ধারের জন্য ছাত্র-কৃষক জনতা পুলিশের উপর ইট পাটকেল ছুড়তে থাকে। শিবপুরের আব্দুল মান্নান খান, মনোহরদীর  জসিম উদ্দিন খোকা, আমিন উল্লাহ এবং আমীর আলীর নেতৃত্বে একটি জঙ্গী মিছিল হাতিরদিয়া বাজারে ঘটনাস্থলে আসে। মিছিলকারীরা ৪ জনকে উদ্ধারের  চেষ্টা চালায়। ৪ জন মুক্তির জন্য শ্লোগান দিতে থাকে।

এরই মধ্যে পুলিশ বিনা উস্কানিতে পাটের গুদাম থেকে কৃষক-জনতার উপর গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে ৩ জন  ঘটনাস্থলে শহীদ হয়। তারা হলেন, মনোহরদী থানার বাসুলীকান্দী গ্রামের সিদ্দিকুর রহমান মাস্টার, নোয়াদিয়া গ্রামের কৃষক মিয়া চাঁন, সোনাকুঁড়া (বর্তমান) সৈয়দের গাঁও গ্রামের মোঃ হাছেন আলী। পুলিশের গুলিতে আহত হয় শিবপুরের শহীদ এএম আসাদুজ্জামান আসাদ, কাপাসিয়া থানার সনমানিয়া গ্রামের সিদ্দিক, শিবপুর থানার বানিয়াদি গ্রামের কলেজ ছাত্র আব্দুল হাইসহ আরো অনেক কৃষক জনতা।

আটক ৪ জনকে পাটের গুদাম থেকে রাত ২ টার দিকে মনোহরদী থানা হাজতে নিয়ে যায়। পরদিন রাত ১ টার দিকে নারায়ণগঞ্জ মহকুমা জেল হাজতে পেরনের উদ্দেশ্যে চালান দেয়া হয়। ৩১ ডিসেম্বর সকাল ৭ টায় নারায়ণগঞ্জ জেল হাজতে পৌছে চার জন ন্যাপ কর্মী এবং শিবপুর থানার মোক্তার খান ও শরিফ হোসেনকে গ্রেফতার করে জেল হাজতে প্রেরণ করে এবং ৬ জনসহ মোট ১৮ জনকে আসামী করে মামলা দায়ের করা হয়। প্রায় ২ বছর মামলা চলার পর রায় আসামীদের বেকসুর খালাস প্রদান করেন মহামান্য  আদালত।

’৬৯’র গণঅভ্যূত্থানের মহানায়ক শহীদ  এএম আসাদুজ্জামান  ১৯৬৯ সালের  মিছিল করতে গিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। শহীদ  আসাদের মৃত্যুকে কেন্দ্র করেই বাংলাদেশে সংগঠিত হয় ঐতিহাসিক ৬৯’র গণঅভ্যূত্থান। ১৯৬৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর শহীদ আসাদ হাতিরদিয়া বাজারে হরতাল পালনকারীদের উপর পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনা থেকে যে অগ্নিষ্ফুলিঙ্গ নিয়ে ঢাকায় গিয়েছিলেন, সেই অগ্নিষ্ফুলিঙ্গই ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যূত্থানের জন্ম দিয়েছিল।

২০ জানুয়ারি ঢাকায় পুলিশের গুলীতে আসাদের শহীদ হবার ঘটনাও, ২৯ ডিসেম্বর হাতিরদিয়া বাজারে হরতাল পালনকারীদের উপর পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা। এই ২ টি ঘটনাই বাঙালীর জাতীয় মুক্তির সংগ্রামের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। অথচ হাতিরদিয়া দিবস ও শহীদ আসাদ দিবস নামে গণঅভ্যূত্থানের দুটি সূচনা দিবস জাতীয়ভাবে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে না। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ কোন রাজনৈতিক দলই দিবস দুটিকে জাতীয় মর্যাদায় উদযাপন করছে না।

হাতিরদিয়া বাজার থেকে শহীদ  আসাদুজ্জামান আসাদ মাথায় আঘাত প্রাপ্ত হয়ে প্রথমে গ্রেফতার হয়েছিলেন। পরে হরতালের পিকেটাররা তাকে পুলিশের হাত থেকে ছিনিয়ে মুক্ত করলে তিনি সেখান থেকে পালিয়ে যান। আসাদুজ্জামান পরে আহত অবস্থায় একটি সাইকেল নিয়ে শিবপুর থেকে ঘোড়াশাল যান। সেখান থেকে ট্রেনযোগে তিনি ঢাকায় পৌছান। পরদিন তিনি এই ঘটনা মাওলানা ভাসানীসহ ঢাকা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও ছাত্র নেতৃবৃন্দকে অবহিত করেন।

একদিন পর এই খবর তৎকালীন দৈনিক আজাদ, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদসহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সেদিনই হাতিরদিয়া বাজারে হরতাল পালনকারীদের উপর পুলিশের গুলি বর্ষণের প্রতিবাদে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ মিছিল হয়। শহীদ আসাদ আইয়ুব খান বিরোধী ছাত্র আন্দোলন জোরদার করার জন্য তৎপর হয়ে উঠেন। ৪ জানুয়ারি ছাত্রদের ১১ দফা এবং বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা দাবীর সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। এতে প্রধান ভূমিকা পালন করেন শহীদ আসাদ।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভনর মোনায়েম খান ১৪৪ ধারা জারী করেন। যাতে করে ৪ জনের বেশী লোক একত্রে জড়ো হতে না পারে। ২০ জানুয়ারি পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী দুপুরে ছাত্রদের নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের পাশে চাঁন খাঁর পুল এলাকায় মিছিল নিয়ে অগ্রসর হতে থাকেন শহীদ আসাদুজ্জামান। পুলিশ তাদেরকে চাঁন খাঁর পুলের ব্রীজে বাধাঁ দেয় এবং তাদেরকে ফিরে যেতে বলে। কিন্তু বিক্ষোভকারী ছাত্ররা দীর্ঘ প্রায় এক ঘন্টা সেখানে অবস্থান করে।

এ সময় আসাদুজ্জামান ও তার সহযোগী ছাত্ররা আইয়ুব খান বিরোধী স্লোগান দিতে থাকে। সে সময় একজন পুলিশ কর্মকর্তা তাকে খুব কাছে গিয়ে শহীদ আসাদের বুক লক্ষ্য করে গুলীবর্ষণ করে। এতে মারাত্মক রক্তাক্ত জখম হয়ে আসাদ মাটিতে লুটিয়ে পড়লে সতীর্থ ছাত্ররা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন । এরপর আসাদুজ্জামানের শহীদ হবার ঘটনা ছড়িয়ে পড়ার পর পরিস্থিতি অশান্ত হয়ে উঠে। ছাত্রদের আন্দোলন গণ-আন্দালনে পরিণত হয়। সংগঠিত হয় ’৬৯’র গণঅভ্যূথান।

এই ’৬৯’র গণঅভ্যূথানের ফলেই পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ূব খান রাষ্ট্র ক্ষমতা ত্যাগ করতে বাধ্য হন। ’৬৯’র গণঅভ্যূথানের প্রেক্ষাপটই হচ্ছে নরসিংদীর হাতিরদিয়া বাজারের পুলিশের গুলিতে হতাহতের ঘটনা। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও এই গুরুত্বপূর্ণ দিনটিকে কেউ উদযাপন করছে না। অভিজ্ঞ স্থানীয় রাজনীতিকরা জানিয়েছেন, হাতিরদিয়া বাজারে হরতাল পালনকালে পুলিশের গুলিতে হতাহতের ঘটনা তথা শহীদ আসাদের আহত হবার ঘটনা না ঘটলে ৬৯’র গণঅভ্যূথান সংগঠিত হতো না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *