কুমিল্লায় গায়ে হলুদে গান বাজানো নিয়ে সংঘর্ষে নিহত-২

কুমিল্লা প্রতিনিধি, আবদুল মান্নান, ০২ এপ্রিল, ২০২১ (বিডি ক্রাইম নিউজ ২৪) : কুমিল্লার দেবীদ্বারে বিয়ে বাড়ির গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে নাচ গানকে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন ২ জন। আহত হয়েছেন আরো ২০ জন। এদের মধ্যে গুরুতর আহত ৩ জনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। হৃদয়বিদারক এ ঘটনাটি ঘটে বুধবার দিবাগত রাত সাড়ে ১১টায় উপজেলার রসুলপুর ইউনিয়নের জীবনপুর গ্রামের ইনসাফ মার্কেট এলাকায়।

ঘটনার পর রাতেই আব্দুল্লাহপুর গ্রামের বিয়ে বাড়ির সাদেক মিয়ার পুত্র ও কনের পিতা মো. জাকির হোসেন (৪৫) এবং প্রতিবেশী জীবনপুর গ্রামের ইব্রাহীম মিয়ার পুত্র বাছির মিয়া(২৫) কে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে আসেন। সংঘর্ষে নিহত দু’জন হলেন, মুরাদনগর উপজেলার গুঞ্জর গ্রামের আবু হানিফের পুত্র কোম্পানীগঞ্জ বদিউল আলম উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্র রাহিম হাসান (১৭) এবং দেবীদ্বার উপজেলার আব্দুল্লাহপুর গ্রামের হাবিবুর রহমানের পুত্র সাইফুল ইসলাম (২০)।

খবর পেয়ে দেবীদ্বার থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আরিফুর রহমান একদল পুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থল থেকে রাহিম হাসান’র মরদেহ ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে সাইফুলের মরদেহ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসেন। পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, বুধবার সন্ধ্যার পর সুবিল ইউনিয়নের আব্দুল্লাহপুর গ্রামের সাদিক মিয়ার বাড়ির প্রবাসী মো. জাকির হোসেন’র কন্যার গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান চলছিল। ওই অনুষ্ঠানকে ঘিরে বাড়ির শিশু-কিশোররা ডেকসেট বাজিয়ে নাচ গান করছিল।

এ সময় পার্শ্ববর্তী মুরাদনগর উপজেলার ১৪নং পূর্ব নবীপুর ইউনিয়নের গুঞ্জর গ্রামের ৫/৬ জন তরুণ-কিশোর এসে নাচে অংশ নেয়। গুঞ্জর গ্রামের অংশ নেয়াদের ইভটিজিং এর ঘটনাও ঘটে। ওই ঘটনায় স্থানীয়দের সাথে গুঞ্জর গ্রামের ছেলেদের কথা কাটাকাটি ও হাতাহাতি হয়। পরে স্থানীয় সাবেক ইউপি মেম্বার জুলহাস মিয়া এসে ডেকসেট বন্ধ ও নাচগান না করতে নিষেধ করে চলে যান। পরে গুঞ্জরের ছেলেরা তাদের এলাকায় খবর দিলে আরো কিছু কিশোর- তরুন ছুটে আসে। ওই সংবাদে স্থানীয় ছেলেরাও ঐক্যবদ্ধ হয়। বিয়ে বাড়ি থেকে প্রায় ৫ শত গজ দূরে ”ইনসাফ মার্কেট”-এ উভয় পক্ষের সংঘর্ষ শুরু হলে পুরো এলাকাই রণক্ষেত্র পরিণত হয়।

এসময় ছুরিকাঘাতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় গুঞ্জর গ্রামের আবু হানিফের পুত্র কোম্পানীগঞ্জ বদিউল আলম উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্র রাহিম হাসান (১৭)। অপর দিকে বুকে ছুরিকাঘাতে মারাত্মক আহত আব্দুল্লাহপুর গ্রামের হাবিবুর রহমানের পুত্র সাইফুল ইসলাম (২০), গুঞ্জর গ্রামের মো. জয়দল হোসেন মোল্লা’র পুত্র মো. আক্তার হোসেন (১৬) ছুরিকাঘাতে তার ভূড়ি বেরিয়ে যায়। একই গ্রামের মজিবুর রহমানের পুত্র মো. মামুনুর রশিদ (২০) তার বুক ও পেটে ছুরিকাঘাতে আহত। আব্দুস সালামের পুত্র মো. সজিব (১৩) তার কণ্ঠনালী কেটে যায়।

তাদের দেবীদ্বার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক ডাঃ মো. আলমগীর হোসেন সাইফুলকে মৃত ঘোষণা করেন। অপর ৩ জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা দিয়ে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়, সেখান থেকে আশংকাজনক অবস্থায় মারাত্মক আহত তিনজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। তাদের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, আহত তিনজনের অবস্থাই আশংকাজনক।

প্রবাসী মো. জাকির হোসেন’র স্ত্রী সেলিনা আক্তার জানান, তার স্বামী মো. জাকির হোসেন ওমান প্রবাসী সেখানে তার বড় ছেলে নাজমুল হাসান (২৫)কে নিয়ে তিনি ওমানে থাকেন। বাড়িতে ছোট ছেলে রহমান ও একমাত্র মেয়ে নাজমা (১৯)কে নিয়ে তিনি বাড়িতে থাকেন। ছোট ছেলে রহমান স্থানীয় আব্দুল্লাহপুর হাজী আমির উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে। তার স্বামী মেয়ের জন্য ওমান প্রবাসী মো. হোসাইন নামে এক ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক করেন। হোসাইন একই উপজেলার প্রতিবেশী বুড়িরপাড় গ্রামের আব্দুল মতিন মিয়ার ছেলে। বর ওমানে থাকা অবস্থায় গত বছরের ২৪ জুলাই টেলিফোনে আমার মেয়ের সাথে বিয়ে সম্পন্ন করেন। মেয়েকে তুলে দিতে আমার স্বামী মার্চ মাসের ৫ তারিখ দেশে আসেন। মেয়ের জামাইও গত সপ্তাহে দেশে আসেন।

গতকাল (বুধবার) ছিল আমার মেয়ের গায়ে হলুদ, আজ (বৃহস্পতিবার) বরযাত্রী আসার কথা ছিল কনে নিয়ে যেতে। গত রাতে একটি অশুভ শক্তির পদদলে থমকে গেল বিয়ের আনন্দ, নিমেষেই সব কিছু মাটি হয়ে গেল। পুলিশ এসে সব আয়োজন বন্ধ করে দিয়ে আমার স্বামীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে যায়।

গুঞ্জর গ্রামের নিহত রাহিমের পিতা অসুস্থ আবু হানিফ বুক চাপড়ে বলেন, আমার ছেলেকে বিয়ে বাড়ির আনন্দ উৎসবে নাচতে নিয়ে গিয়েছিল তার বন্ধু সাইফুল। সাইফুলও মারা গেল সাথে আমার ছেলেও মরল, কেন এমনটা হল তার বিচার চাই। নিহত সাইফুলের মা’ আউলিয়া আক্তার সন্তানের ছবি বুকে নিয়ে সন্তানের শোকে বার বার মুর্ছা যাচ্ছেন, আর বলছেন, দায় দেনা করে সৌদী আরব যাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। ৫দিন পর পাসপোর্ট হাতে এলে যাওয়ার দিন তারিখ ঠিক করার কথা বলে আহাজারী আর্তনাদ করছেন।

স্থানীয় আব্দুল্লাহপুর গ্রামের আলী হোসেন জানান, আমাদের এ এলাকার মেয়েরা গুঞ্জরের বখাটে ছেলেদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিল। ওরা আমাদের এলাকার মেয়েদের সাথে প্রায়ই ইভটিজিং করত। গত কিছুদিন পূর্বে গুঞ্জরের ছেলেদের বিরুদ্ধে ইভটিজিং’র দায়ে একটি সালিসও হয়েছিল। তার রেশ শেষ না হতেই আবারো একটি বড় ধরণের ঘটনা ঘটে গেল।

দেবীদ্বার থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আরিফুর রহমান বলেন, বিয়ের হলুদ অনুষ্ঠানে ডেকসেট বাজিয়ে নাচ গানের সময় ইভটিজিং এর ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রথমে বাকবিতন্ডা হাতাহাতি পরে বিয়ে বাড়ি থেকে প্রায় ৫শত গজ দুরে ইনসাফ মার্কেটে যেয়ে দু’পক্ষের সংঘর্ষে এ হতাহতের ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এসেছি, তদন্ত চলছে, লাশ ময়না তদন্তের জন্য কুমেক হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত তিন জনেরই অবস্থা আশংকাজনক। মামলা প্রক্রিয়াধীন।

বৃহস্পতিবার দুপুরে কুমিল্লা জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহরিয়ার আলম মিয়াজী ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে জানান, বিয়ে বাড়ির একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। তদন্ত চলছে, তদন্ত শেষে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *