শরীর আছে ; কিন্তু শারীরিক শিক্ষা দিতে রাজী নন তারা : মোশাররফ হোসেন মুসা

সম্পাদকীয় (কলাম), ১০ জুলাই, ২০২২ (বিডি ক্রাইম নিউজ ২৪) : একদিন এক হাসপাতালে পরিচিত এক মাওলানার সাথে দেখা। তিনি কট্টর কথাবার্তা পছন্দ করেন না, সেজন্য তার সঙ্গে আমার কিছুটা খাতির। সেদিন তার সঙ্গে তার স্ত্রী ছিলেন। স্ত্রীকে দেখানোর জন্য একজন মহিলা ডাক্তারের খোঁজ করছিলেন। আমি ঠাট্টাচ্ছলে বললাম- ‘নিজের মেয়েকে ডাক্তারি পড়াবেন না; অথচ স্ত্রীর অসুখ হলে মহিলা ডাক্তারের খোঁজ করবেন, এ কেমন কথা!’ তিনি হাসতে হাসতে আমার কথার সমর্থন জানালেন। যাহোক, একসময় এলএম এ এফ পাশ করা ডাক্তারের কাছে এদেশের নারী-পুরুষ উভয়েই চিকিৎসা করাতেন।

এখনো গ্রামে-গঞ্জে পল্লী চিকিৎসকের কাছে মহিলারা অবলীলায় তাদের অসুখের কথা বলে থাকে। দিন দিন চিকিৎসা পদ্ধতি উন্নত হচ্ছে, বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু মানুষের পশ্চাতপদ চিন্তা-ভাবনা দূর হচ্ছে না। বর্তমানে প্রথম সারীর প্রায় ৪৫ জন গাইনি চিকিৎসক আছেন। তাদের মধ্যে মাত্র ৫ জন পুরুষ ডাক্তার। অর্থ্যাৎ দৃষ্টিভঙ্গি গত কারণে একজন পুরুষ ডাক্তার গাইনি বিশেষজ্ঞ হতে চান না।

একজন নারীর বয়ঃসন্ধি কাল থেকে পিরিয়ড হওয়া শুরু হয়। প্রতি চন্দ্রমাসের পরপর হরমোন গত কারণে রক্তস্রাব হয়। এক সময় এটাকে অভিশাপ হিসেবে দেখা হতো (এখনো দেখা হয়)। সেজন্য খুবই গোপনে তারা জরায়ুতে কাপড় পেচিয়ে রাখতো। নোংরা কাপড় ব্যবহারের কারণে গোপনাঙ্গে বিভিন্ন চর্ম রোগ দেখা দিতো। বর্তমানে বিষয়টি আর গোপনীয় হিসেবে দেখা হয় না। ঔষধের দোকান সহ বিভিন্ন স্টেশনারি দোকানেও ন্যাপকিন প্যাড পাওয়া যায়।

বর্তমান সরকার বিভিন্ন বিদ্যালয়ে (বিশেষ করে বালিকা বিদ্যালয়ে) ন্যাপকিন প্যাড কর্নার চালু করার চিন্তাভাবনা করছে। পিরিয়ড হওয়া মানে একজন নারী গর্ভধারণে সক্ষম সেটা প্রাথমিক ভাবে ধরে নেয়া। নারীরা সন্তান জন্ম দিচ্ছে বলেই মানবকুল টিকে আছে। এটা কোনো গোপনীয় বিষয় নয়; বরং খোলাখুলি আলোচনার বিষয়।

হরমোনগত কারণে যুবকরাও বিভিন্ন সমস্যায় পড়ে থাকে। মানবদেহে মাথা, ঘাড়, বক্ষ, বাহু, পা, যৌনাঙ্গ সহ দেহের বাহিরে ও অভ্যন্তরে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রয়েছে। বিভিন্ন কারণে এসব অঙ্গ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারে। চিকিৎসা বিদ্যার শিক্ষার্থীদের শব-ব্যবচ্ছেদ (Anatomist) করে এসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সম্পর্কে হাতে কলমে শিক্ষা দেয়া হয়।

প্রখ্যাত চিকিৎসক ইবনে সিনাও না কি গোরস্থানে গিয়ে লাশ উত্তোলন করে শবব্যবচ্ছেদ করতেন এবং চিকিৎসা বিদ্যা নিয়ে নানা রকম পরীক্ষা- নিরীক্ষা করতেন। সেজন্য তাঁকে তৎকালীন সময়ে শাসক ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর রোষানলে পড়তে হয়েছিল (মজার বিষয় হলো, বর্তমানে তাঁকে নিয়ে ধর্মীয় মৌলবাদীরা গর্ব করে থাকে; কিন্তু তারা জানে না, চিকিৎসক- বিজ্ঞানীরা কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের লোকদের জন্য তাদের আবিস্কার সীমাবদ্ধ রাখেন না)।

শিক্ষা অধিদপ্তর প্রথম শ্রেণী থেকে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত চারু-কারুশিল্পের পাশাপাশি শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা নামে একটি বিষয় খুলেছে। এসব সাবজেক্টে শারীরিক অনুশীলন, খেলাধূলা ও স্বাস্থ্য বিধি সম্পর্কে সুন্দর বর্ণনা রয়েছে। বিশেষ করে ৫ম শ্রেণী থেকে ১০ম শ্রেণীর বইগুলোতে বয়ঃসন্ধীকালের স্বাস্থ্য রক্ষা সম্পর্কে চমৎকার বর্ণনা রয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীদের শারীরিক অনুশীলন ও স্কাউটিং শেখানো হলেও এক শ্রেণীর কূপমণ্ডূক শিক্ষক ও বিদ্যমান ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর কারণে বিদ্যালয়ে স্বাস্থ্য বিধি বিষয়ে তেমন কিছু পড়ানো হয় না।

একসময় গ্যালিলিওকে সুর্যের চারদিকে পৃথিবী ঘুরে এমন তত্ত্ব দেয়ার কারণে কাঠগড়ায় দাড়াতে হয়েছিল। বিচারক তাঁর মতামত পাল্টাতে বললে তিনি না কি বিড়বিড় করে বলেছিলেন- ‘আমি মত পাল্টালেও পৃথিবী সুর্যের চারদিকেই ঘুরবে।’ তেমনি শরীর থাকলে অসুখ থাকবে, আর সেই অসুখ কোনো ঝাড়ফুক ও তুকতাকে সারবে না। বিধায় ডাক্তারের কাছে যেতেই হবে। যেহেতু যেতে হবে, তাহলে শারীরিক শিক্ষা দিতে বাধা দেয়া হচ্ছে কেন তা ভেবে দেখা দরকার।

লেখক: গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ক গবেষক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *